চট্টগ্রাম : মহানগরীর সরকারি স্কুলগুলো এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএমএস)-এর আওতায় ডিজিটাল নজরদারিতে ততটা আগ্রহ নেই মহানগরীর সরকারি স্কুলগুলোর! এই সিস্টেমের আওতায় আসতে বিভিন্ন রকমের সমস্যার কথা বলছেন স্কুল সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এটি চালু হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের ফাঁকি–বাজির সুযোগ অনেকটাই বন্ধ হয়ে যাবে, মূলত এই কারণেই এই সিস্টেমের আওতায় আসতে স্কুলগুলো ততটা আগ্রহী নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দাবি– শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় স্কুলে কমপক্ষে দুই থেকে তিনটি বায়োমেট্রিক ডিভাইস স্থাপনের প্রয়োজন পড়বে। তাই খরচটাও বেশি পড়বে। এর ফলে সিস্টেমটি চালু করতে অর্থ সংকটের কথাই বেশি বললেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা।
এর বাইরে স্কুলে লোকবল সংকট ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতির কথাও জানিয়েছেন একাধিক প্রধান শিক্ষক। স্কুল শুরু ও ছুটির সময় এক সাথে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী কিভাবে মেশিনে কার্ড বা ফিঙ্গার প্রিন্ট দিবে তা নিয়েও দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন কেউ কেউ। আবার স্কুলে এটি চালু করতে গেলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি সার্কুলার জারির প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছেন কোন কোন প্রধান শিক্ষক।
তবে সিস্টেমের মাধ্যমে অনলাইন তদারকিতে আনা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতা অনেকাংশেই বাড়বে বলে অভিমত জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনের। জেলা প্রশাসকের দাবি–এর মাধ্যমে ছাত্র–ছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও ফাঁকি–বাজি কমবে। ইচ্ছে মাফিক স্কুল–কলেজে আসা–যাওয়ার সুযোগ আর থাকবেনা। তাই খুব সহজে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই সিস্টেমের আওতায় আসতে আগ্রহ দেখাবে না। কিন্তু যতই সমস্যা থাকুক স্কুলগুলোকে অবশ্যই এই সিস্টেমের আওতায় আনার কথা জানালেন মেজবাহ উদ্দিন। এ নিয়ে আগামী সপ্তাহেই স্কুল প্রধানদের নিয়ে আবারো বৈঠক করবেন বলেও জানান তিনি।
ইএমএস ও এর ব্যবহার: অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সার্বক্ষণিক নজরদারির লক্ষ্যে বিশেষ এই সিস্টেম তৈরি করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। ইএমএস (এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) নামের এই সিস্টেমের মাধ্যমে যে কোন স্থান থেকে যে কোন সময় সিস্টেমের আওতাভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য জানতে পারবে তদারককারী কর্তৃপক্ষ। এসব তথ্যের মধ্যে শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের উপস্থিতি, উপস্থিত–অনুপস্থিতির সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্থানের সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখযোগ্য। তবে এই তদারকি কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য কেবল একটি বায়োমেট্রিক ডিভাইস স্থাপন করতে হবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। যাতে ডিজিটাল আইডি কার্ড ও আঙ্গুলের ছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) দেওয়ার উভয় সিস্টেমই চালু থাকবে। এর মধ্যে যে কোন একটি পদ্ধতিতে (আইডি কার্ড অথবা আঙ্গুলের ছাপ) বায়োমেট্রিক ডিভাইসে নিজেদের উপস্থিতি ও প্রস্থান নিশ্চিত করার সুযোগ পাবেন শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা। আর এর যে কোন একটি পদ্ধতিতে বায়োমেট্রিক ডিভাইসে উপস্থিতি বা প্রস্থান নিশ্চিত করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব তথ্য অনলাইনে সন্নিবেশ হবে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বা কোন ব্যক্তিকেই অনলাইনে কোন প্রকার তথ্য ইনপুট দেওয়ার (আপলোড করার) প্রয়োজন পড়বে না। যা সিস্টেমটির সবচেয়ে বড় সুবিধা বলে মনে করেন এটি তৈরির সাথে যুক্ত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এল এ) মো. দৌলতুজ্জামান খাঁন।
বায়োমেট্রিক ডিভাইসটি ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাড়তি কোন সার্ভার, কম্পিউটার, ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট, অনলাইন ইউপিএস কোন কিছুরই প্রয়োজন পড়বেনা জানিয়ে দৌলতুজ্জামান খাঁন বলেন– ডিভাইসটিতে ব্যাটারি যুক্ত থাকবে। ফলে বিদ্যুৎ চলে গেলেও ডিভাইসটি চালু থাকবে। আর অন/অফ অপশন থাকায় প্রয়োজনীয় সময়ের পর কর্তৃপক্ষ চাইলে ডিভাইসটি অফ করে রাখতে পারবেন। আবার চালুও করতে পারবেন।
ডিভাইসটি স্থাপনে সর্বোচ্চ ১৮–২০ হাজার টাকা খরচ পড়বে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা বলেন– ডিজিটাল আইডি কার্ড বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ থেকেই এই খরচ দিতে পারবে প্রতিষ্ঠানগুলো। ন্যূনতম পাঁচশ শিক্ষার্থী রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানে আইডি কার্ড বাবদ শিক্ষার্থী প্রতি সর্বোচ্চ একশ টাকা নিলেই এ সংক্রান্ত সব ধরণের খরচ মেটানো যাবে। বাড়তি কোন টাকার প্রয়োজন পড়বে না।
এদিকে, কেবল উপস্থিতি–অনুপস্থিতিই নয়, এই সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষক–কর্মচারির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও সব ধরনের তথ্য অনলাইনে সন্নিবেশ থাকবে। আর অটো এসএমএস প্রক্রিয়ায় ছাত্র–ছাত্রীদের প্রবেশ ও প্রস্থানের সুনিদিষ্ট সময়ের পাশাপাশি অনুপস্থিত থাকার খবরও জানানো যাবে অভিভাবকদের। এর বাইরেও অনলাইনে সন্নিবেশ থাকবে প্রতিটি শিক্ষার্থীর রেজাল্ট কার্ড (বোর্ডের নম্বরপত্রের আদলে)। আর স্বয়ংক্রিয় এসএমএস’র মাধ্যমে এই রেজাল্টও পৌঁছানো যাবে অভিভাবকের মোবাইলে। তাছাড়া এই সিস্টেমে প্রোফাইল আকারে প্রতিটি শিক্ষক–কর্মচারির প্রয়োজনীয় সব তথ্য যুক্ত থাকবে।
দীর্ঘ সাত মাসেরও বেশি সময় নিয়ে এই ইএমএস সিস্টেমটি তৈরি করেছে চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন। জেলাপ্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনের নির্দেশনায় সিস্টেমটি তৈরিতে কাজ করেছেন অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (এল এ) মো. দৌলতুজ্জামান খাঁন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তদারকিতে এই অনলাইন সিস্টেমটি একটি আদর্শ, সময়োপযোগী ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। আর এই ইএমএস’র মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে বলে অভিমত অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (এল এ) মো. দৌলতুজ্জামান খাঁনের।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে– সিস্টেমটি তৈরিতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে স্পেকট্রাম আইটি সল্যুশন লিমিটেড নামের একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। তৈরির পর পরীক্ষামূলক নয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ইএমএস’র মাধ্যমে অনলাইন তদারকি কার্যক্রম চালু রাখা হয়। পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে ইতিবাচক ফল পাওয়ার পর গত ১৮ জুলাই সিস্টেমটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. রুহুল আমীন এর উদ্বোধন করেন। জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের সরকারি–বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ছাড়াও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালতি সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই সিস্টেম চালুর আগ্রহের কথা জানান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিকের) প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা নাজিয়া শিরিন। যা এখন প্রক্রিয়াধীন বলে জানালেন অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক মো. দৌলতুজ্জামান খাঁন।
আর উদ্বোধনের এক মাসের মধ্যেই সরকারি স্কুলগুলোকে এই সিস্টেমের আওতায় আনার ঘোষণা দেন জেলাপ্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন। এ লক্ষ্যে উদ্বোধনের দুইদিন পর (২০ জুলাই) নগরীর নয়টি সরকারি স্কুল প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক মো. দৌলতুজ্জমান খাঁন। সিস্টেমের আওতায় আসতে গেলে এসময় বিভিন্ন সমস্যার কথা বৈঠকে তুলে ধরেন স্কুল প্রধানরা। সবকয়টি স্কুলই সমস্যার কথা জানায়। ফলে উদ্বোধনের এক মাস শেষ হতে চললেও সরকারি একটি স্কুলকেও এর আওতায় আনা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসমত জাহান আজাদীকে বলেন, আমাদের স্কুলে দুই হাজার ছাত্রী আছে। এদের জন্য একটি মেশিন তো কখনোই পর্যাপ্ত হবে না। কমপক্ষে তিনটি মেশিন প্রয়োজন হবে।
আর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আইডি কার্ড বাবদ নেওয়া ফি এর খরচের জন্য পর্যাপ্ত হবে না। কারণ, আইডি কার্ড বাবদ সরকারি স্কুলে ৫০ টাকার বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে বাকি টাকা আমরা কোথায় পাবো। একই কথা জানালেন সিটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা পূরবী চৌধুরীও। তিনি বলেন, আমরা আমাদের সমস্যার কথা জানিয়েছি। সমস্যার বিষয়গুলো অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক দেখবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। এদিকে, সিস্টেমটি যথেষ্ট যুগোপযোগী দাবি করে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউল হক হেনরী বলেন, আমাদের কিছু সমস্যা রয়েছে। স্কুলের অভ্যন্তরে একটি মসজিদ আছে। আর স্কুলের বাউন্ডারি দেয়ালটা আমরা এখনো সম্পূর্ণ করতে পারিনি। তাই নিরাপত্তার বিষয়টুকুও আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে। ফলে আমরা সময়টুকু চেয়েছি। তবে এটি চালু হলে ইতিবাচক ফল আসবে বলে মত ব্যক্ত করেন তিনি। সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ইতকণা চৌধুরী বলেন, আমরা সিস্টেমটি চালুর বিপক্ষে নই। কিন্তু এটি চালুর আগে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সে পদক্ষেপগুলো গ্রহণের জন্য আমরা প্রশাসনকে অনুরোধ করেছি।
খরচের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা আগ্রহী ব্যক্তির মাধ্যমে স্কুলগুলোতে ডিভাইসগুলো ফ্রি–তে দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে চেষ্টা চলছে বলে জানালেন অতিরিক্ত জেলাপ্রশাসক (এল এ) মো. দৌলতুজ্জামান খাঁন। আর এ নিয়ে আগামী সপ্তাহেই সরকারি স্কুল প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করার কথা জানিয়ে জেলাপ্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেন– আমি (জেলাপ্রশাসক) সরকারি স্কুলগুলোর কমিটির সভাপতি। তাই সবার আগে সরকারি স্কুলগুলোকে অবশ্যই এই সিস্টেমের আওতায় আনা হবে। যত সমস্যাই থাকুক। সমস্যা আমরা দেখবো।