বিএনপি সম্প্রতি র‌্যাব ও তাদের বর্তমান এবং সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ভবিষ্যতে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গত প্রায় এক দশক যাবৎ সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিচারবহির্ভূত হত্যা করছে। এ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে রিপোর্টও প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তা বারবার প্রত্যাখ্যান করে এ ধরনের অপরাধকে অধিক হারে উৎসাহিত করা হয়। অস্বীকার করার ফলাফলই হচ্ছে মার্কিন এ নিষেধাজ্ঞা।

আজ বুধবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিকভাবে দলের অবস্থান তুলে ধরে এসব কথা বলেন। এ সময় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে গত সোমবার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। সেখানে আলোচনা শেষে মার্কিন নিষেজ্ঞা বিষয়ে দলের অবস্থান সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, সম্প্রতি ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন’র অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক নির্বাহী আদেশে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক মহাপরিচালক এবং বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শকসহ র‌্যাবের ৬ জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর আর্থিক ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রধানতম বন্ধুপ্রতীম অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক কৌশলগত অংশীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অত্যন্ত বিব্রতকর ও উদ্ধেগজনক। তবে তা ছিল নিঃসন্দেহে অবশ্যম্ভাবী।’

কারণ উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘গত এক দশক ধরে বিএনপিসহ বাংলাদেশের প্রায় সকল গণতন্ত্র চর্চায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন ও ভয়াবহ নির্যাতনের বিষয়ে দেশের ভেতরে ও বহির্বিশ্বের নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে ব্যাপকভাবে আলোচিত।’

এ সময় সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুম, বাংলাদেশ সফররত তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও বেগম খালেদা জিয়ার সাক্ষাতকালে পিতাকে ফিরে পেতে আকুতি জানিয়ে ইলিয়াস শিশুকন্যার চিঠি, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদকে নিখোঁজের পর ভারতের মেঘালয়ে আবিষ্কার, সাংবাদিক কাজলকে ৫৩ দিন পর ভারতের সীমান্তবর্তী বেনাপোলে খুঁজে পাওয়া, কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের বাঁচার তীব্র আকুতি, পুলিশ কর্মকর্তার হাতে সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনাকে গুলি করে হত্যা প্রসঙ্গ তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল।

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ছয় শতাধিক গুম, ২০১৮ সাল থেকে প্রায় ৬০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনে র‌্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় রয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এই নিষেধাজ্ঞার ফলে একটি পরাশক্তি রাষ্ট্র কর্তৃক বড় ধরনের মানবাধিকার লংঘনকারী হিসাবে চিহ্নিত হওয়ায় ভবিষ্যতে জাতিসংঘের শান্তি মিশন মোতায়েনও প্রভাবিত করতে পারে। এর ফলে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও আইন শৃংখলা বাহিনীর উপরে নীতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।’

বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য, শ্রমশক্তি, নিরাপত্তা সার্ভিস রপ্তানি নির্ভর দেশের জন্য এই নিষেধাজ্ঞার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। এর ফলে বহির্বিশ্বে আমাদের দেশ ও নাগরিক সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে। যা বিদেশী বিনিয়োগসহ নানা ধরনের আর্থনৈতিক ও দৈনন্দিন সহযোগিতা কার্যক্রমকে ব্যাহত করবে। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও শান্তিপ্রিয় দেশের কাছে বাংলাদেশের ইমেজ ব্যাপকভাবে ক্ষুন্ন হবে। অথচ এরকম পরিস্থিতিতেও সরকারের মন্ত্রীরা র‌্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগকে ‘কাল্পনিক অভিযোগ’ বলে উড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এমনকি অযাচিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন মানবাধিকার পরিস্থিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মুল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার গতানুগতিক অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের মন্তব্য, বিবৃতি দেখে মনে হচ্ছে যেন, হঠাৎ করে এই অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসেই এ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে বিচারবহির্ভুত হত্যা, গুম, নির্যাতন সম্পর্কে রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যথারীতি তা প্রত্যাখ্যান করে এধরনের অপরাধকে অধিক হারে উৎসাহিত করা হয়। সবচেয়ে নৈরাশ্যজনক বিষয় হচ্ছে, সরকারের তরফ থেকে গত প্রায় একদশক যাবৎ র‌্যাব, পুলিশসহ অন্যান্য আইন শৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিএনপিসহ ভিন্নমতের মানুষদের গুমের সংস্কৃতি চালু রেখেছে সেটাকেই তারা অস্বীকার করে চলেছে। মূলত সরকারের বিচারবহির্ভুত হত্যাকে অস্বীকার করার ফলাফলই হচ্ছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ থেকে এই নিষেধাজ্ঞা।’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘রূঢ় শোনালেও এটা অস্বীকার করার সুযোগ নাই, ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক এই নিষেধাজ্ঞা বর্তমান চলমান গণ ও মানবতা বিরোধী সরকারের জন্য সমগ্র বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী বার্তা। আর সেটা হলো কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ ধরনের বিচারহীন সংস্কৃতি চলতে পারে না। কেবলমাত্র একটা অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনকালেই এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কর্তৃক আয়োজিত ‘সামিট ফর ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র সম্মেলন’ এ বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোর মধ্যে দিয়ে তা আরও সুস্পষ্ট হয়।’ তিনি বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সম্পূর্ণ দায় আওয়ামী লীগের।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশের সমগ্র মানুষের সামনে এটা একটা জাতীয় সমস্যা। আর জাতীয় সমস্যা জাতীয়ভাবে সবাইকে নিয়ে সমাধান করতে হয়। আর সেটা তখন কেবল তখনই সম্ভব, যখন দেশে একটা গণতান্ত্রিক সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে। কারণ, গণতন্ত্রবিহীন সমাজে জবাবদিহিতা প্রতিটি পদে পদে বিঘ্নিত হয়, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যমান। মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কখোনোই সুনিশ্চিত থাকে না। বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, মাদার অব ডেমোক্রেসি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসায় বিদেশ প্রেরণে সরকারের প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি তার সর্বশেষ উদাহরণ।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘দেশে অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজনের পথ পরিস্কার করে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক ব্যবস্থা করে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করে দেশে মানবাধিকার ও বিচার পাওয়ার অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনকালে এটাই হতে পারে সমগ্র দেশবাসীর জন্য সর্বোত্তম প্রাপ্তি।’

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031