এবার আলোচনায় এলেন এক ভুয়া সচিবের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠতার’ ইস্যুতে নানা সময়ে নানা ইস্যুতে আলোচনায় থাকা মুসা বিন শমসের চৌধুরী । প্রতারণার মাধ্যমে বহু মানুষকে পথে বসানো কাদের নামের ওই ভুয়া সচিবের সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ মিলেছে। আর্থিক লেনদেনের চুক্তি পাওয়া গেছে কয়েকটি।
এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সম্পদ বিবরণী দাখিল করে তিনি হৈচৈ ফেলে দেন। বিবরণীতে তিনি উল্লেখ করেন সুইস ব্যাংকে তার ৯৩ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। এর বাইরে ঢাকার সাভার ও গাজীপুরে ১ হাজার ২০০ বিঘা জমি আছে। দেশে রয়েছে বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এর মধ্যে গুলশান ও বনানীতে বাড়ির তথ্য দেন। তার এই বিশাল সম্পদের তদন্ত করতে গিয়ে হিমশিম খায় দুদক টিম। দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি দল তদন্ত করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েন। মুসা বিন শমসের সুইস ব্যাংকসহ যে টাকার হিসাব দেখিয়েছেন, বাস্তবে এখন পর্যন্ত তার কোনো সত্যতা বা তথ্য উপাত্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি গাজীপুর ও সাভারে যে সম্পদের বর্ণনা দিয়েছেন, তারও সত্যতা মেলেনি। দুদক টিম এ বিষয়ে কমিশনে যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, তাতে মুসা বিন শমসেরকে একজন মিথ্যুক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। দুদক কর্মকর্তারা বলেন, মুসা বিন শমসের তার যে সম্পদ থাকার কথা বলছেন তা ভুয়া। তিনি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে দুদকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে আমাদের তদন্ত চলছে। শিগগিরই তদন্ত শেষ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, মুসা বিন শমসের অসদুদ্দেশ্যে দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ঢাকার সাভার ও গাজীপুরে ১ হাজার ২০০ বিঘা জমি এবং সুইস ব্যাংকের ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৯৩ হাজার কোটি টাকা) থাকার কথা বলেছে। সেই সম্পদ অর্জনের উৎসের সমর্থনে কোনো রেকর্ডপত্র দাখিল করতে ব্যর্থ হন তিনি। অনুসন্ধানকালে ঢাকা ও গাজীপুর জেলা রেজিস্ট্রার অফিসের রেকর্ডপত্র তল্লাশি করেও মুসা বিন শমসের ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা চৌধুরীর কোনো প্রকার জমি ক্রয়-বিক্রয় করার তথ্য পাওয়া যায়নি।
দুদকের তথ্য মতে, মুসা বিন শমসেরের সুইস ব্যাংকের ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৯৩ হাজার কোটি টাকা) জমা থাকার বিষয়ে তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একাধিবার চিঠি দেয় দুদক। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংকের এই টাকার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
দুদকের কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, সুইজারল্যান্ডে ৮৮টি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে কোন কোন ব্যাংকে তার টাকা জমা আছে, তার কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। দুদক টিম তদন্তের স্বার্থে বারবার চিঠি দিচ্ছে। চিঠির জবাব পাওয়া গেলেও টাকা জমা বা জব্দ থাকার তথ্য উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে, যুক্তরাজ্য থেকে আনা একটি গাড়ি জালিয়াতির মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে বিক্রির অপরাধে মুসা বিন শমসেরসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় ২ কোটি ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৩ টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়। মামলায় বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক মো. আইয়ুব আনসারী, ফারিদ নাবীর, মুসা বিন শমসের, তার শ্যালক মো. ফারুক উজ জামান ও মেসার্স অটো ডিফাইনের মালিক মো. ওয়াহিদুর রহমানকে আসামি করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সিরাজুল হক।
দুদকের তদন্ত টিম মুসা বিন শমসেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদের দিন তিনি সাদা রঙের মারসিডিস বেঞ্জের গাড়িতে চড়ে ছয়জন নারী দেহরক্ষীসহ প্রায় ৫০ জনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাবাহিনী নিয়ে দুদক কার্যালয়ে আসেন। তখন তার গাড়ির সামনে ও পেছনে ডজনখানেক গাড়ি ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুদক কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মুসা বিন শমসের। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চ আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ছিলাম। পরদিন তিনি আমাদের যার যার এলাকায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। আমি নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে ফরিদপুর যাই। ২২ এপ্রিল পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা পড়ি। আমি তাদের হাতে বন্দি ছিলাম। একাত্তর সালের ৯ ডিসেম্বর অর্ধমৃত অবস্থায় মুক্তি পাই।’
সুইস ব্যাংক ১২ বিলিয়ন জব্দ কেন করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইরেগুলার ট্রানজেকশনের কারণে করেছে। কোর্ট আমার পক্ষে আছেন। শিগগিরই এ বিষয়ে রিপোর্ট পাব।’ সুইস ব্যাংকের অর্থ ফেরত এলে দেশে বিনিয়োগ করবেন বলে জানান মুসা।
এর আগে ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫০ লাখ পাউন্ড অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন মুসা বিন শমশের। তিনি জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা করলেও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো তার পরিচিতি তুলে ধরেছে অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে।
এরপর ২০১০ সালে সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মুসা বিন শমসেরের ৭ বিলিয়ন ডলার জব্দ করায় পশ্চিমা গণমাধ্যমে ঝড় উঠেছিল। অনিয়মিত লেনদেনের কারণে তার অর্থ জব্দ করা হয় বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিলে একবার তার সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুদক। কিন্তু সেই অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বেশি দূর এগোয়নি।
এরপর ২০১৪ সালে বিজনেস এশিয়া ম্যাগাজিন মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশি অস্ত্র ব্যবসায়ীর ৭ বিলিয়ন ডলার আটকে আছে সুইস ব্যাংকে। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর কমিশনের নিয়মিত বৈঠকে মুসা বিন শমসেরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। কমিশনের সিনিয়র উপপরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) মীর জয়নুল আবেদিন শিবলীকে বিষয়টি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয় কমিশন। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তার সত্যতা পাওয়া যায়নি।