রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’ নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। মিয়ানমার ছেড়ে আসার আগে সেখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন বলেই এমন নাম তার। ২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্ববাসীর নজরে এসেছিলেন তিনি। সে সময় গণহত্যা বিরোধী একটি সমাবেশে নাগরিত্ব প্রদান, নিরাপত্তা, রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটা ফেরতসহ কয়েকটি দাবি পূরণ না হওয়ায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ।
মুহিবুল্লাহ ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করেছিলেন। যেটির চেয়ারম্যানও করা হয় তাকে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিলেন তিনি। আর এই কারণেই খুন করা হয়েছে তাকে, এমনটাই দাবি স্বজনদের।এ ব্যাপারে মুহিবুল্লাহর মেঝভাই হাবিবুল্লাহ গণমাধ্যমকে জানান, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনা বাহিনীর নির্যাতনের কারণে প্রাণ বাঁচাতে মুহিবুল্লাহসহ তারা ৩ ভাই পরিবার নিয়ে পালিয়ে উখিয়ায় চলে আসেন। তাদের পরিবারে রয়েছে স্ত্রী ও ৯ সন্তান। যার মধ্যে মেয়ে রয়েছে ৫ জন ও ছেলে রয়েছে ৪ জন।
তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘ দিন ধরে একটি গ্রুপ আমার ভাইকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। সে গ্রুপ হচ্ছে প্রত্যাবাসন বিরোধী।২০/২১ জন লোক আমার ভাইয়ের অফিসে আসে। তারা আমেরিকা বাংলাদেশ-মিয়ানমার এই তিন দেশ এর বিষয় ও প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করে। এসময় মহিবুল্লাহ তাদেরকে বলছিলেন , আমেরিকাসহ বিশ্ব সম্প্রদায় এখন একমত হয়েছে আমাদেরকে আমাদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, আমরাও প্রস্তুত রয়েছি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য। এ কথা বলার পর বন্দুকধারীরা আমার ভাই কে গুলি করে হত্যা করে। প্রত্যাবাসনের কারণে দীর্ঘদিন থেকে তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল।’
নিহত মহিবুল্লার ভাই হাবিবুল্লাহ আরও বলেন, ‘ঘাতকদের মুখে কোন মাস্ক ছিলনা। আমার ভাইকে পরপর চারটি গুলি করে। গুলির শব্দ শুনে আমরা সবাই দৌড়ে যাই। এরপর তারা পালিয়ে যায়। এশারের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে গিয়ে তিনি অফিসে বসে ছিলেন। এরপর এ ঘটনা ঘটে।’
‘আমরা দুই ভাই, একসাথে এশারের নামাজ আদায় করেছি, এরপর, আমার ভাই অফিসে যায়, আর আমি ভাত খেতে যাই বাসায়, এর মধ্যেই এই ঘটনা ঘটে।আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে আমি যাদেরকে দেখেছি তারা হলেন, মাস্টার আব্দুর রহিম, মোরশেদ, নাগো, আরেকজন কাল করে মাথায় লম্বা চুল। সবার হাতে অস্ত্র ছিল।’
নিহত রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে নানাভাবে আবেদন জানিয়ে আসছিলেন বলে রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা আমাদের সম্পদ কে হারিয়ে ফেলেছি। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ হাসানুজ্জামান পিপিএম বলেন, ‘নিহত মহিবুল্লার মৃতদেহ সদর হাসপাতালে রয়েছে। তবে এখনো মামলা হয়নি।’ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তবে এ ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় আলোচনার প্রধান বিষয় এখন নিহত মহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে সর্বত্র।
উল্লেখ্য, গতকাল বুধবার রাত সাড়ে টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-১ ইস্ট-ওয়েস্ট (ডি ব্লকে) এশার নামাজ শেষে নিজ অফিসে অবস্থানকালে অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীরা ৫ রাউন্ড গুলি করে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে। ৩ রাউন্ড গুলি বুকে লাগলে তার মৃত্যু হয়। তাকে প্রথমে ব্লকের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গতকাল দিবাগত রাত ২টার দিকে মুহিবুল্লাহ মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্সে ছিলেন তার মেঝ ভাই হাবিবুল্লাহ, ছোট ভাই আহম্মদ উল্লাহ ও মুহিবুল্লাহর প্রতিবেশী নুরুল আমিন।