এমএলএমের (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং অর্থাৎ বহুস্তর বিপণন) নামে প্রতারণা চলছেই । ভিন্ন নামে ভিন্ন কৌশলে, ব্যবসার আদলে এমএলএম কোম্পানিগুলো মানুষের কাছে হাজির হলেও এদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মূলত প্রতারণা। এবং সেটা করেই সময়মতো তারা সটকে পড়েন। ডিজিটাল যুগে প্রতারকচক্র এখন হাজির হয়েছে অনলাইনেও। গত বৃহস্পতিবারের ‘আমাদের সময়ে’ এ-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। ‘এমএলএম এখন অনলাইনে ৩শ কোটি টাকা নিয়ে উধাও সাত কোম্পানি’ শিরোনামের খবরে প্রকাশ, ‘গত এক সপ্তাহেই অন্তত ৭টি কোম্পানি বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের প্রায় তিনশ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। প্রতারণার শিকারদের বেশিরভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। লকডাউনের মধ্যে কিছুটা আয়ের আশায় এসব অনলাইন এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ভুক্তভোগীরা এখন হা-হুতাশ করছেন।’

এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে হা-হুতাশ করার ঘটনা নতুন নয়। তিন দশক ধরে এই ব্যবসা চলছে এবং কিছুদিন পর পরই এখানে যারা বিনিয়োগ করছেন তাদের সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে এবং সেই খবর যথারীতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এ কারণে দু-একজন গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটছে এবং কিছুদিন পর তারা জামিন পেয়ে যথারীতি বেরিয়েও আসছেন, তারা কিং বা তাদের ভাবশিষ্যরা একই কৌশলে অন্য নাম ও রঙ লাগিয়ে ব্যবসা করেই যাচ্ছেন। দু-একজন হয়তো জামিন পান না, কিন্তু জামিন না পেলেও তারা হাসপাতালে থাকার সুযোগ পান এবং জুম মিটিং করার নজিরও সৃষ্টি করেন। ফলে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে আইনের ফাঁকফোকর যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে নিয়ম-কানুনের মধ্যে প্রকৃত সলতে পাকানোর খামতি আর ইঁদুর-বিলাই খেলার করুণ বাস্তবতা। এ খেলা যেহেতু চলমান প্রক্রিয়া এবং এর রেফারি যেহেতু চান না কখনই বন্ধ হোক প্রতারণার নামে সর্বনাশা এই খেলা, তাই তিনি শেষ বাঁশি বাজান না, কিংবা বাজানোর মুরোদ নেই তার। বড়জোর তিনি পারেন বিরতি দিতে তাও আবার মিনিটখানেকের জন্য। এই বিরতি আসলে খেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতারকদের আরও শক্তি জোগায় নতুন করে গতি ফিরিয়ে আনতে। এভাবে শক্তি পেয়ে প্রতারকরা এতটাই উদ্যমী-সৃজনশীল ও সাহসী হয়ে উঠেছে যে, এখন তারা অনলাইন প্ল্যাটফরমকেও ব্যবহার করেছেন জুতসইভাবে। যার বড় নজির হলো এক সপ্তাহে সাতটি কোম্পানির গ্রাহকদের বিনিয়োগকৃত ৩শ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হওয়ার ঘটনা।

এমএলএম কোম্পানির প্রতারণার ঘটনা এবারই প্রথম কিংবা আনকোরা না হলেও কেন বারবার ঘটছে এই ঘটনা? এই প্রশ্নের উত্তর তালাশ করা জরুরি। দায়টা কার বা কাদের এবং কোথায় এই কোম্পানিগুলোর প্রতারণা শক্তির জাদুকরী শক্তির উৎস সেটা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।
এমএলএম ব্যবসা অনেক পুরনো একটা প্রতারণা কৌশল। ফিলিপ মেডোস টেলর আমাদের জানাচ্ছেন যে কথা বিখ্যাত ঠগিকাহিনি গ্রন্থে- ‘ভারতবর্ষ জুড়িয়া ঠগিগণ অকুতোভয়ে দস্যুতা করিতেছে। প্রথমত, মধ্যপ্রদেশসমূহেই ইহাদের অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া গিয়াছিলÑ কিন্তু যেমন দূর দূর স্থান হইতে ‘বিভীষণের’ আমদানি হইতে লাগিল, অমনি বুঝিতে পারা গেল যে, ঠগিদের ব্যবসায় প্রদেশবিশেষে সীমাবদ্ধ নহে উপরন্তু ভারতব্যাপীÑ হিমালয় হইতে কুমারিকা পর্যন্ত, কচ্ছদেশ হইতে আসাম পর্যন্ত, এমন প্রদেশ নাই যেথায় ঠগিগণের কর্তৃক নিহত শত শত নিরীহ পথিকের কঙ্কাল মৃত্তিকা মধ্যে প্রোথিক থাকিয়া দেশব্যাপী অরাজকতার নির্বাক নিদর্শনরূপে বিরাজ না করিতেছে।’

‘অনেক জেলায় ম্যাজিস্ট্রেট কিছুতেই স্বীকার করিলেন না যে, তাহাদের অজ্ঞাতসারে অথচ তাহাদের এত নিকটে এতদিন ধরিয়া এ প্রকার নীরব লুণ্ঠন ও হত্যাকা- অভিনীত হইয়াছে।’

ঠগিদিগের অত্যাচারে কত ধন-রত্নই না লুণ্ঠিত হইত, কত লোকই না নিহত হইত। এই ঘাতকগণের হস্তে বৎসর বৎসর কত সহস্র নিরীহ পথিকই না অকালে শমন সদনে গমন করিয়াছে! ভাবিতে হৃদয় শিহরিয়া উঠে।’

ঠগিরা বিনাশ হয়েছে হয়তো, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মা এখনো বিনাশ হয়নি, উপরন্তু তারা হয়েছে সবিশেষ বাড়-বাড়ন্ত। বাংলাদেশের গত তিন দশকের বাস্তবতা এই সত্যকেই হাজির করেছে রূঢ়রূপে।

সেদিনের ভারতবর্ষ আজ স্বাধীন তিনটা রাষ্ট্র, যার একটা আমাদের প্রিয়তম মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাংলাদেশেরও প্রায় সর্বত্র ঠগিদের কারবার চলছে দেদার, যার বর্তমান সংস্করণ ও বিবর্তিত রূপকে বলা যেতে পারে এমএলএম ব্যবসা। এদের রাজধানীকেন্দ্রিক প্রতারণার খবর হয়তো আমরা সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানতে পারি। কিন্তু রাজধানীর বাইরের বিভাগীয় জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যন্ত এ ধরনের ব্যবসার নজির বিদ্যমান। ঠগিরূপী প্রতারকচক্র যে কতটা ভয়ঙ্কর ও কৌশলী তা কল্পনা করাও দুরূহ।

নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার একটি কেসস্টাডি প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে করা হলো হাজির-নাজির। কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার পদ্মা নদীতীরবর্তী একটা গ্রামের নাম ফিলিপনগর। সেই গ্রামে ১৯৯০ সালের শেষাশেষি হাজির হন একজন ফেরিওয়ালা। অদ্ভুত তার ব্যবসার ধরন, তিনি পিতলের পুরনো জিনিস সংগ্রহ করেন। ভাঙ্গা, টোসকা খাওয়া, ফুটো হয়ে যাওয়া কিংবা পুরনো হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো সংগ্রহ করে তিনি নিয়ে যান এবং এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সেগুলো একদম নতুন করে তৈরি করে এনে দেন। বিনিময়ে তিনি কোনো টাকা নেন না, কেউ যদি খুশি হয়ে দেন তা হলে ভিন্ন কথা। গ্রামের মানুষ মনে করেন দারুণ একখান সুযোগ বটে। তবে প্রথমবার বিশ^াসে একটু খটকা থাকায় একটা-দুটো দেন কিংবা দেনই না, অন্যদের দেওয়াটা দেখে সত্যিই আসে কিনা সেটা নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন। লোকটি পরিচয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি উনার কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার হরিপুর গ্রামে।

দশ দিন পর লোকটি সত্যিই ফিরে আসেন এবং সরকার বাড়ি বলে পরিচিত বাড়ির সামনে হন হাজির। গ্রামের মানুষ বিস্মিত এবং হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করে এ সুযোগ হাতছাড়া করেন না। যার যত পিতলের কলস, প্লেট, চামচ, কাপ, পিরিচ সব দিয়ে দেন। পুরো গ্রামবাসীর সামনেই ঘটে ঘটনাটি। সেখানে গ্রামের সাধারণ মানুষ যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন তরুণ আইনজীবী, স্কুল শিক্ষক, নাইওরে আসা জামাইসহ অনেকেই। কারও মনেই প্রশ্ন জাগেনি, কীভাবে এটা সম্ভব, উনার স্বার্থ কী? শুধু মাধ্যমিক পড়ুয়া একজন কিশোর জানতে চেয়েছিলেন উনার লাভ কী, উনি ফিরে আসবেন তার নিশ্চয়তা কোথায়, এটা তো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়, কিন্তু কেউ আমলে নেয়নি সেই তরুণের কথা, ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, পুরো এলাকার পিতলের জিনিসপত্র লোকটি গাড়ি ভাড়া করে সেই যে নিয়ে গিয়েছে আজও ফেরেনি।

এ রকম গল্পের অভাব নেই আমাদের ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের দেশে। চাকরিরত ছেলের বন্ধু পরিচয় দিয়ে হাজির হন কেউ কেউ। তার পর দুই-তিন দিনের জামাই আদর নিয়ে জমানো টাকা-পয়সা নিয়ে বাড়ির মোটরবাইক নিয়ে সটকে পড়ার মতো কিছু একটা নিয়ে সটকে পড়েন চিরতরে। এরা ঠগিÑ এরা এমএলএম কোম্পানির নানারকম প্রতারণার একটা ধরন। যে ধরনে ফি বছর কিংবা প্রতিবছরই শিকার হচ্ছেন কেউ না কেউ। যার সর্বসাম্প্রতিক নজির অনলাইনে এমএলএম কোম্পানি খুলে ৩শ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দেওয়ার ঘটনা।

এমএলএম কোম্পানি কিংবা এ ধরনের ব্যবসার বিরুদ্ধে যেভাবে শক্ত অবস্থান নেওয়ার দরকার ছিল সেটা নেওয়া হয়নি। ঠগিদের বিরুদ্ধে যেভাবে শক্ত অবস্থান নিয়ে সমূলে বিনাশ করা হয়েছিল তা করা হচ্ছে না। আমরা এখন পর্যন্ত দেখা পাইনি একজন স্লিম্যানের। ইংরেজ প্রশাসক হয়েও তিনি সেই সময়ের স্থানীয় মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার লক্ষ্যে অভূতপূর্ব সাহসী ও সময়োপযোগী যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা আজও তুলনারহিত।

এমএলএম কোম্পানির প্রতারণা ব্যবসা বন্ধে শুধু আইন প্রয়োগ করলেই হবে না, জনগণের মধ্যে এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা জরুরি। জনগণকে সচেতন না হলে এবং তাদের প্রয়োজনানুগ সব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সচেতন করে তোলা না হলে, আইন থাকা না থাকাট সমানই হবে বৈকি।

জনগণকে সচেতনা করার ক্ষেত্রে সামাজিক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। সমাজের মধ্যে যদি এসবের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সচেতনতা তৈরি হয় তবে তারা যতভাবে ও যত রঙঢঙ লাগিয়ে হাজির হোক না কেন খুব সহজে প্রতারণা করতে পারবে না, এখন যেভাবে পারছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে পারে। এমনকি মসজিদ-মন্দির-গির্জাগুলোতেও প্রার্থনা শেষে কিংবা প্রার্থনার পরে বিশেষ আলোচনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ ব্যাপারে কী করা যেতে পারে- কীভাবে করা যেতে পারে সেই ব্যাপারে ভেবে দেখতে পারে। তাদের শিক্ষার্থীরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসছে। পাঠ্যপুস্তকেও এ ব্যাপারে বিশেষ পাঠের ব্যবস্থা করা যেতে পারে কিনা তা নিয়েও আলোচনা করা জরুরি।

সর্বোপরি রাষ্ট্রের দায়ই মুখ্য। রাষ্ট্র যেহেতু নানা বিধি ও নিয়ম-কানুন দ্বারা সুশৃঙ্খল একটি প্রতিষ্ঠান, তাই তাকেই নিশ্চিত করতে হবে তার নাগরিককে প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখার ব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধাদি। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে তার এসব পাওয়া শুধু নিয়তি ও নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, অধিকারও বটে।

ঠগিদের ইতিহাস ঘাঁটলে এবং এমএলএম ব্যবসার ভেতর-বাইর পর্যবেক্ষণ করলে উভয়ের মধ্যে বড়ই সাদৃশ্য বিদ্যমান। ফলে এ প্রশ্নও সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত কারণেই এ প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি যে, আজকের এমএলএম ব্যবসায়ীরাই কি ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতবর্ষের অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের ঠগি?

ঠগিদের ইতিহাস পাঠান্তে আমরা দেখি, তারাও তাদের এই দুর্বৃত্তপনা-লুণ্ঠন ও হত্যাকা-কে ব্যবসা বলে অভিহিত করছেন। প্রতারকচক্রও নানা যুক্তিতর্ক হাজির করে এমএলএম কোম্পানির ব্যবসাকে ব্যবসা বলে চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আদতে এটা প্রতারণা বই অন্যকিছু নয়। আমাদের লোভ, আয়েশি মনোভাব, তড়িঘড়ি অর্জন প্রয়াস এবং বিবেকবর্জিত চিন্তাভাবনা ও অর্থ আয় কিংবা অন্য কোনো সুবিধা প্রাপ্তির মানসিকতা এমএলএম কোম্পানিগুলোকে প্রতিনিয়ত সুযোগ করে দিচ্ছে। তাই নিজেদের সচেতন হওয়ার কথাও যেন আমরা ভুলে না যাই।

মনে রাখতে হবে প্রতারিত হওয়ার পর আইনের আশ্রয় যদি আপনি পানও তা হলে প্রতারকের বড়জোর কয়েকদিনের হাজতবাস কিংবা জেলবাস হয়, আপনার সর্বস্ব খোয়ানোর কিছুই হয় না উসুল। কারণ আমাদের আইনি ব্যবস্থা প্রতারকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির আজও হাজির করতে পারেনি। অথচ ঠগিদের অপরাধকর্ম স্লিম্যানের মাধ্যমে উন্মোচিত হওয়ার পর ১৭২৭ জনের ফাঁসি-দ্বীপান্তর-যাবজ্জীবন কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তির কথা স্পষ্ট করেই জানা যায়। কিন্তু গত তিন দশকে যারা এমএলএমের নামে মানুষকে পথে বসিয়েছে- সর্বস্ব হারিয়ে মৃত্যুর দিকে কিংবা মৃতবৎ জীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছে তাদের কি কিছু করা সম্ভব হয়েছে আজও?

ড. কাজল রশীদ শাহীন : সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031