পরীমনির ধর্ষণচেষ্টার মামলার অভিযোগের কোনো সত্যতা মিলছে না সাভারের ব্লোটক্লাবের ঘটনায় ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমের সামনে স্পষ্ট করে কিছু না বললেও তদন্তে পরীমনির অভিযোগের উল্টো দৃশ্যই উঠে আসছে বলে জানা গেছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মামলায় পরীমনি যে অভিযোগ করেছিলেন, তদন্তে তার কানিভাগ সত্যতাও মিলছে না। বরং উল্টো দৃশ্যই উঠে আসছে তদন্তের নানা পর্বে। তাই মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে। সে অনুযায়ী চলতি মাসেই চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন ঊর্ধ্বতন ওই কর্মকর্তা।
বিরুলিয়ায় ঢাকা বোট ক্লাবে গত ৮ জুন রাতে তাকে ধর্ষণচেষ্টা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে সাভার মডেল থানায় মামলা করেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। নানা নাটকীয়তার পর গত ১৩ জুন দায়ের করা ওই মামলায় তিনি আসামি করেন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন ইউ মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমিসহ অজ্ঞাত আরও চারজনকে। এর আগে ওই রাতেই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাসে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগ তুলে বিচার চান তিনি। বিষয়টি নিয়ে ওই দিন রাতে সংবাদ সম্মেলনও করেন আলোচিত এই নায়িকা।
এরপর পরই মামলাটি নিয়ে অস্বাভাবিক তৎপর হয় পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তার বন্ধু অমিসহ পাঁচজনকে। রিমান্ডেও নেওয়া হয় তাদের। রাজধানীর উত্তরায় অমির বাসায় তল্লাশি চালিয়ে জব্দ করা হয় এক হাজার পিস ইয়াবা, বিদেশি মদ ও বিয়ার। তখন এক প্রতিক্রিয়ায় বিতর্কিত এই চিত্রনায়িকা বলেছিলেন- ‘এত দ্রুতই প্রধান আসামি গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন ভরসা পাচ্ছি। নিশ্চিন্ত হলাম। বাঁচতে পারব। বাকি অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরও দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক।’
আলোচিত এ মামলার পর সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা বোট ক্লাবের ওই রাতের চিত্র এবং ঠিক আগের রাতে গুলশানের অভিজাত অল-কমিউনিটি ক্লাবে ভাঙচুর ও তুলকালাম কা- ঘটানোর চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রচার হয় গণমাধ্যমেও। এর পরই মামলার সত্যতা নিয়ে চলে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। আর সেই আলোচনা গড়ায় জাতীয় সংসদেও। নেটিজেনরা সরব হয়ে ওঠেন ফেসবুকে। পরে পাঁচ হাজার টাকার মুচলেকায় গত ২৯ জুন বিকালে জামিনের আদেশ পান ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ। তার দুদিন পর ১ জুলাই কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্ত হন।
এর মধ্যে ৪ আগস্ট নানা নাটকীয়তার পর পরীমনির বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। বিপুল পরিমাণ বিদেশি মাদকসহ গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকাইয়া সিনেমার এ নায়িকাকে। সেই সঙ্গে মোড় ঘুরে যায় তার দায়ের করা মামলার তদন্তও। এর মধ্যে একটি মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েন শিথিলের সঙ্গে পরীমনির ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সামনে এলে বিব্রত হয় পুলিশ প্রশাসন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের এই অতিরিক্ত উপকমিশনারের সরকারি ফ্ল্যাটে বাদীর আসা-যাওয়া ছিল। এমনকি তারা বিয়ে করেছেন বলেও চাউর হয়।
এদিকে তদন্তের জন্য পরীমনিকে ডেকে এনে সাভার মডেল থানায় ভিভিআইপি মর্যাদা দিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা। আপ্যায়ন করা হয়েছিল হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি, দই-মিষ্টি আর কোমল পানীয় দিয়ে। এমনকি ‘বাঁকা প্রশ্ন’ এড়াতে ও নায়িকার ‘সম্মান রক্ষা’য় থানাতে পর্যন্ত গণমাধ্যমকর্মীদেরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি সেদিন। আজ সেই কর্মকর্তাদের মুখেই উল্টো সুর। মামলার অগ্রগতির বিষয়ে ওসি কাজী মাইনুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি যেন বেশ বিব্রতবোধ করেন। স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে এ মুর্হূতে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। মুখে কুলুপ এঁটেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেনও। তদন্তের বিষয়ে কোনো কথাই বলতে চাননি তিনি।
ঢাকা জেলা উত্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল্লাহিল কাফি অবশ্য জানান, পরীমনির মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গেই তদন্ত করা হচ্ছে। তবে এর বেশি আর কিছু বলতে চাননি পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। একইভাবে মামলার তদন্ত নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি ঢাকার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদারও। ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমান কেবল জানান, মামলাটির তদন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তদন্তকারী একটি সূত্র বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে পরীমনির করা মামলাটি ১৮০ দিনে নিষ্পত্তির আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে লকডাউন ও হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকার পরও পুলিশ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হলে মিথ্যা মামলা করার কারণে ফেঁসেও যেতে পারেন এ নায়িকা। কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭-এর ২ ধারায় মিথ্যা অভিযোগের শাস্তির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে সূত্রটি বলেছে- ওই আইনে মিথ্যা মামলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ৪ মার্চ ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের মোছা. শামসুন্নাহারকে দুই বছর সশ্রম কারাদ- ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেন।
অন্যকে ফাঁসাতে গিয়ে এবার পরীমনিও ফেঁসে যাচ্ছেন কিনা, তা সময়েই জানা যাবে। এ বিষয়ে মামলার প্রধান আসামি ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন ইউ মাহমুদ আমাদের সময়কে অবশ্য বলেন, ‘আমার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। যে মানহানি হয়েছে তা আর ফিরে পাব না। আমি এর বিচার চাই। আমি আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত রিপোর্টেই বের হয়ে আসবে, আমি অপরাধী কিনা। পরীমনি যেটি বলেছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তার অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। ৮ তারিখ রাতে মামলা করেননি। পরের চার দিনও মামলা করতে পারেননি। এটি খতিয়ে দেখলেই পরীমনির উদ্দেশ্য বেরিয়ে আসবে। এরই মধ্যে তার যেসব কর্মকা- আমরা জানতে পেরেছি; তিনি কেবল একজন অভিনেত্রীই নন, অপরাধ করার ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত।’