ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সড়ক প্রায় ফাঁকা। কঠোর লকডাউনের প্রথম সকাল। কিছুক্ষণ পরপর টুং টাং বেল বাজিয়ে ছুটে যাচ্ছে রিকশা। কখনো কখনো মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার। এরমধ্যেই ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণির ফুটপাথে কাঁথা মোড়া দিয়ে শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছেন আছিয়া বেগম। পাশে বসে আছেন তার স্বামী নবাব উল্লাহ ও পরিচিত দু’জন। তারা সবাই দিনমজুর।
আছিয়া কাজ করেন রেস্টুরেন্টে। গতকাল কঠোর লকডাউনের প্রথমদিনে কাজ ছিল না দিনমজুরদের। পুরানা পল্টন মোড়ের রেস্টুরেন্টটি খোলা থাকলেও অর্ধেক কর্মীকে ছুটি দেয়া হয়েছে। কারণ রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার নিয়ম না থাকায় বেচা-বিক্রি কম। নবাব উল্লাহ জানান, জমানো টাকা দিয়ে খাবার খেয়েছেন। ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনেছেন। কতদিন এভাবে চলা যাবে। কিন্তু লকডাউন দীর্ঘমেয়াদি হলে না খেয়ে মরতে হবে। লকডাউনে, বৃষ্টিতে ফুটপাথেই আশ্রয় তাদের।
দুপুর গড়িয়ে আসতেই রামপুরা এলাকায় চোখে পড়ে অন্যরকম দৃশ্য। ভ্যানে করে যাচ্ছেন তিনজন। এক পুরুষ ও দুই নারী। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল। এক গর্ভবতী নারীকে কাঁথা-বালিশে শুইয়ে ধরে রেখেছেন এক নারী। চলতে চলতে কথা হয় তাদের সঙ্গে। ওই নারী রংমিস্ত্রি ফিরোজ মিয়ার স্ত্রী। থাকেন বাড্ডা এলাকায়। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সড়কে গাড়ি নেই। এম্বুলেন্সগুলো অনেক টাকা দাবি করে। রিকশায় নেয়া সম্ভব না। বাধ্য হয়েই ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছেন।
বেলা ৩টা। পুরানা পল্টন মোড়ে বসে আছেন তিন পুলিশ সদস্য। হঠাৎ করেই রেইনকোট পরিহিত এক পুলিশ সদস্য লাঠিচার্জ করেন এক কিশোরকে। ওই এলাকার সড়ক তখন প্রায় জনশূন্য। রিকশাচালকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে। খোলা রয়েছে ওষুধ দোকান, রেস্টুরেন্ট। পুলিশের মার খেয়ে কিশোর কাঁদছিলো। ওই কিশোরের নাম আশরাফুল। বাড়ি চাঁদপুরে। ফকিরাপুলে মেসে থাকেন তার বাবা। ভাই থাকেন নয়াপল্টনে। দুপুরের খাবার খেতে বাবার কাছে গিয়েছিলো। খাবার শেষে বায়তুল মোকাররম হয়ে পুরানা পল্টন দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো।
দুপুরে ধানমণ্ডি এলাকায় দেখা গেছে, রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী। পথচারীদের পরিচয়পত্র তল্লাশি ও বাসা থেকে বের হওয়ার কারণ জানতে চাচ্ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সিগন্যালে পুলিশের চেকপোস্ট দেখা গেছে। সেখানে চিকিৎসকের গাড়ি পরিচয় দেয়া মাত্র ছেড়ে দেয়া হচ্ছিলো। অন্যান্য গাড়ি থামিয়ে পরিচয়পত্র দেখে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।
বহুতল ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন অনেকে। দৃশ্যপট দেখতে অদূরে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন। পাশে দাঁড়ানো পুলিশ সদস্যরা সেদিকে নজর দিতেই দৌড়ে পালিয়ে যায় তারা। একই দৃশ্য দেখা গেছে শান্তিনগর মোড়ে। পুলিশ ও বিজিবি’র টহল দেখতে ভিড় করছিলেন অনেকে। তাদের একজন রহিম মোল্লা। বাসার সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। একইভাবে চা, সিগারেটের দোকান খুঁজছিলেন মধ্য বয়সী আরও একজন। পুলিশ তাদের প্রতি চড়াও হলে তবেই রাস্তা ছেড়ে বাসার দিকে পা বাড়ান।
লকডাউনকে কেন্দ্র করে শান্তিনগর বাজারে কিছু পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন বিক্রেতারা। খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালান ঢাকা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট। রূপচর্চা জেনারেল স্টোরসহ বেশ কয়েক দোকান মালিককে জরিমানা করা হয়। এ সময় পুলিশ ও বিজিবি ওই এলাকায় টহল দিচ্ছিলো। প্রায় যানবাহনহীন শহরে ট্রাফিক পুলিশ ছিল খুবই কম। এরমধ্যে বিকাল ৪টার দিকে মৎস্য ভবন এলাকায় সাত কনস্টেবল ও একজন সার্জেন্টকে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। মগবাজার, বাংলামোটর, এফডিসি সংলগ্ন সড়কে ছিল পুলিশের কঠোর অবস্থান। গুলশান, বনানী এলাকায় রিকশা থাকলেও যাত্রী ছিল না প্রায়। রাস্তা ফাঁকা। কোথাও কোথাও আড্ডা দিচ্ছিলো অ্যাপসে অর্ডার নিয়ে খাবার পার্সেলকারী প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যানরা। তাদের একজন লুবন। তিনি জানান, লকডাউন হলেও অর্ডার কম। কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, লকডাউনের আগের দিন সবাই খাবার কিনে রাখছে।
রামপুরা ও মালিবাগ এলাকায় রিকশাচালক রফিক জানান, যাত্রী কম। তবে যাত্রীরা বকশিশ দিচ্ছেন খুশি হয়ে। তবুও অন্যদিনের চেয়ে তা কম। বেলা ৩টা পর্যন্ত রুজি তার হয়েছে সাড়ে ৩শ’ টাকা। রিকশাচালক রজতের কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ। মালিবাগ রেললাইন এলাকায় রিকশা থামাতে থামাতে তিনি বলছিলেন, এভাবে বেশিদিন লকডাউন থাকলে সংসার চলবো না।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031