ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে গত এক দশকে শ্রীলঙ্কায় মুসলিম বিরোধিতা । কিন্তু ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইস্টার সানডেতে কলম্বো এবং বাত্তিকালোয়াতে সুসংগঠিত আত্মঘাতী বোমা হামলার ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। এর দু’বছর পরে রাজাপাকসের প্রশাসন মুসলিম নারীদের বোরকা পরা নিষিদ্ধ করার কথা বিবেচনা করছে। একই সঙ্গে কমপক্ষে ১০০০ ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র, যা মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিত, তা জাতীয় নিরাপত্তায় উদ্বেগের অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ইস্টার হামলার জন্য শ্রীলঙ্কায় সালাফি আন্দোলন এবং মাদ্রাসা বৃদ্ধিকে দায়ী করেন দেশটিতে ক্ষমতাসীন অভিজাত ও রাজনীতিকরা। তারা মনে করেন, মাদ্রাসাগুলোতে শুধুই ইসলামপন্থি উগ্রবাদ শিখানো হয়। সিংহলি বৌদ্ধ উগ্রপন্থিরা যাকে ইসলামী উগ্রবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে, তারা চায় এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিক।
শ্রীলঙ্কায় মুসলিমরা সংখ্যালঘু।
পুরো দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৯.২ ভাগ হলেন মুসলিম। সেখানে এই সম্প্রদায় আর্থ সামাজিক ব্যাকগ্রাউন্ডের ভিত্তিতে প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত। তারা হলেন, শ্রীলঙ্কান মুরন, ইন্ডিয়ান মুরস এবং মালয়। অন্য গ্রুপগুলোর মধ্যে আছে মেমোনস এবং বোহরাস। বেশির ভাগ, শতকরা ৬২ ভাগ মুসলিম বসবাস করেন দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে। এ এলাকাগুলো সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে শতকরা ৩৮ ভাগ মুসলিম বসবাস করেন তামিল অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে।
শ্রীলঙ্কান সরকার বোরকা এবং মাদ্রাসা বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছে, তাকে ইতিবাচকভাবে নেননি মুসলিমরা। তারা এটাকে তাদের মুসলিম পরিচয়ের অবমাননা বলে মনে করেন। বোরকা নিষিদ্ধকরণ এবং মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়ায় খুব খারাপ প্রভাব পড়বে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মুসলিমদের জীবনে। কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমই সেখানে শিক্ষা ও অর্থনীতি থেকে পিছিয়ে আছেন।
শ্রীলঙ্কায় বহু মুসলিম নারী ঘরের বাইরে যেতে ইসলামিক বিধান মেনে বোরকা পরেন। তারা শিক্ষার জন্য এবং ঘরের বাইরে কাজে বোরকা পরেন। কিন্তু এই বোরকা নিষিদ্ধকরণের ফলে বহু নারী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিধা নিতে সক্ষম হবেন না। তারা বোরকা ছাড়া বাইরে বেরুতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না।
এখানেই শেষ নয়। প্রায় এক হাজার অনিবন্ধিত মাদ্রাসা বন্ধ করে দিতে চাইছে সরকার। এসব মাদ্রাসায় সাধারণত যেসব শিক্ষার্থী পড়তে যায়, তারা অর্থনৈতিকভাবে একপেশে হয়ে পড়া পরিবারের সন্তান। তারা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা পেতে লড়াই করে। নি¤œ আয়ের পরিবারের মুসলিম শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করে ভাড়া করা বাড়িতে। বিশেষ করে শহর এলাকায়। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকার কারণে সরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তির সুযোগ পায় না তারা। শুধু রাজধানী কলম্বোতে প্রায় ৫ হাজার শিশু সরকারি স্কুলে ভর্তি হতে পারে না।
এ জন্য অমুসলিম শিক্ষার্থীদের চেয়ে অনেক কম সংখ্যক মুসলিম শিক্ষার্থী সরকারি বা বেসরসারি স্কুলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশোনার সুযোগ পায়। এর কারণ, আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা। এই প্রবণতা শ্রীলঙ্কা স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রয়ে গেছে। এমন যেসব শিশুর শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে, সেই বিপুল সংখ্যক মুসলিম শিক্ষার্থীদের প্রধানত টার্গেট করে স্থানীয় মাদ্রাসাগুলো। অনেক শিশুকে স্কুলের পড়াশোনা বাদ দিতে হয়। কারণ, তারা শিক্ষার ফি পরিশোধ করতে পারে না। আবার অনেক পরিবার মনে করেন তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠালে সেখানে ধর্মীয় শিক্ষা পাবে। তাই অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলো তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় পাঠান।
এসব শিশুকে মাদ্রাসায় পাঠানো হচ্ছে এ বিষয়টি শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী রাজনীতিকদের মাথায় রাখা উচিত। কারণ, সরকারি স্কুলগুলোতে সুযোগের ঘাটতি রয়েছে। তাই সরকারের উচিত তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা এবং সবার জন্য এর সুবিধা বিস্তৃত করা।
যেহেতু অর্থনৈতিকভাবে বিপন্ন মুসলিম শিশুদের টার্গেট করে মাদ্রাসাগুলো, তাই সরকারের উচিত তাদেরকে তহবিল দেয়া এবং একটি পাঠাক্রম ও শিক্ষা কর্মসূচিতে মুসলিম প-িতদের নিয়োগ দেয়া। মাদ্রাসা সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথভাবে পরিচালনার দায়িত্ব আছে রাষ্ট্রের। এক্ষেত্রে বিদেশি কোনো দেশের আর্থিক সহায়তাকে সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। তবে তা বন্ধ করে দেয়া একেবারে উচিত নয়। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যেসব সিলেবাস তা প্রস্তুত করা উচিত মুসলিমদের অনুমোদনপ্রাপ্ত পণ্ডিতদের দিয়ে, যারা ভালভাবে ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে জানেন।
মুসলিম সম্প্রদায়কে অনেক সময় তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি সংগঠন ভিন্নপথে পরিচালিত করে। ইস্টার বোমা হামলা এটাই ইঙ্গিত করে যে, ইসলামপন্থি জঙ্গিদের দৃষ্টি শ্রীলঙ্কায় পড়েছে। তারা স্থানীয় উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছে এবং এর মধ্য দিয়ে তাদের এজেন্ডা পূর্ণ করতে চাইছে। ২০১৬ সালে সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে, শ্রীলঙ্কার সুশিক্ষিত এবং অভিজাত পরিবারের ৩২ জন মুসলিম সিরিয়ার আইএসে যোগ দিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় ইসলামপন্থি মৌলবাদের পক্ষে এটা একটা প্রমাণ।
সন্ত্রাস যেখান থেকেই আসুক, সে বিষয়ে নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেয়ার আইনগত যৌক্তিকতা আছে শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের। ইসলামিক স্টেটের মতো ইসলামপন্থি দলগুলো আঞ্চলিক মেরুকরণের জন্য সচেষ্ট। তারা সদস্য সংগ্রহ করে। এ জন্য শ্রীলঙ্কা হতে পারে তাদের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র। কিন্তু এই হুমকি মোকাবিলা করা যেতে পারে এমন উপায়ে, যেখানে মুসলিমদের মনে হবে না তাদের সংস্কৃতিকে পর্যায়ক্রমে টার্গেট করা হচ্ছে। মুসলিম অভিজাত এবং নাগরিক সমাজের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে এসব বিষয়ে সমাধান করা উচিত শ্রীলঙ্কার। এর মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থি উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যেতে পারে। এড়ানো যেতে পারে বৈষম্যমূলক নিষিদ্ধকর এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া।
(লেখক যুক্তরাষ্ট্রের দেলাওয়ার ভ্যালি ইউনিভার্সিটিতে লিবারেল আর্টস ডিপার্টমেন্টের একজন পিএইচডি স্কলার। তার এ লেখাটি অনলাইন ইস্ট এশিয়া ফোরাম থেকে অনুবাদ)