নতুন কিছু শব্দবন্দ যুক্ত করেছে করোনার আগমন রাজনীতি কোষে । এরমধ্যে একটি হল ভ্যাকসিন কূটনীতি। বাহারি সব নামে কূটনীতি এগিয়ে চলছে। এমন বহুল আলোচিত কিছু কূটনীতি হল পিংপং, সাটল, চেকবুক, গানবোট প্রভৃতি। সম্প্রতি চীন প্রণীত নেকড়ে যোদ্ধা কূটনীতিও আলোচিত ঘটনা।

ভ্যাকসিন কূটনীতি নিয়ে আলোচনার পূর্বে কূটনীতি বিষয়ে কিছু জেনে নেয়া যাক। কূটনীতির ইংরেজি হল Diplomacy। শব্দটি গ্রিক শব্দ  Diplon থেকে এসেছে। এর অর্থ হল ভাঁজ করা।

বুঝা যায় সম্পর্ককে ভাঁজ করে রাখার নামই হল কূটনীতি।

ইংরেজিতে কূটনীতির সহজ একটি সংজ্ঞা হল, ‘যখন তুমি কাউকে বোঝাতে পারো যে, যে জিনিসটা তুমি পাবে না, সেটা তুমি মোটেও চাওনা-সেই কলাকৌশলই হল কূটনীতি। ‘ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল মন্তব্য করেছেন, ‘কূটনীতি হল এমন এক আর্ট, তুমি কাউকে জাহান্নামে যাও বলবে এমনভাবে, যেন সে তোমার কাছে এসে সেখানে যাওয়ার ঠিকানা খোঁজ করে।’ বুঝতে পারা যাচ্ছে কূটনীতি সহজ কোনো কর্ম নয়। এটা এক জটিল খেলা যা সবার ধরাছোঁয়ার মাঝে থাকে না। বিশেষ ব্যক্তিরাই এই খেলায় বিজয়ী হয়। এই বিজয়ের সর্বোত্তম একটি পন্থা পাওয়া যায় চীনা সমর বিশেষজ্ঞ সানজু-এর কথায়। তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধের সর্বোত্তম পথ হলো, একটি গুলি খরচ না করেও শত্রুকে ঘায়েল করা। ‘

কূটনীতি ব্যাপারটা বহু পুরনো। রাষ্ট্রধারণার সাথে সাথে কূনীতিও সমানতালে এগিয়েছে। প্রাচীন গ্রীসে বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। দূত বিনিমিয়ের প্রথাও প্রাচীন আমল থেকেই চলে আসছে। এইদূতরাই মূলত কূটনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। পঞ্চদশ শতক থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রে অন্য রাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপন শুরু হয়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দূতাবাস থেকে কূটনৈতিক কাজ পরিচালিত হয়ে থাকে।

যাই হোক এবার ফিরে আসি ভ্যাকসিন কূটনীতিতে। করোনা একদিকে মানুষের প্রাণ হরণ করছে, অন্যদিকে এ নিয়ে বিশ্বরাজনীতিও জমে উঠছে। এটা প্রমাণিত যে, ভ্যাকসিনই করোনা প্রতিরোধের প্রধান উপায়। এরজন্য গতবছর থেকেই শোনা যাচ্ছিল উন্নত দেশগুলো সবার আগে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ভ্যাকসিন পেতে অপেক্ষা করতে হবে। হয়েছেও তাই, এখন ওসেটাই চলছে।

সবার আগে নিজের দেশ। বাঁচলে পরে অন্যদেশকে সহযোগিতা করা যাবে। করোনা এসে বিশ্বায়নের গতি শ্লথ করে দিয়েছে। গ্লোবাল ভিলেজ একক ভিলেজের পথে যাত্রা শুরু করেছে। সংরক্ষণবাদ তত্ত্বকে সজীব করতেও করোনা প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।

এরপরও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক রাষ্ট্রই বেশি আক্রান্ত দেশকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যদিয়েই আমেজ ছড়াচ্ছে ভ্যাকসিন কূটনীতি। কিছুদিন আগে চীন ও রাশিয়া এই কূটনীতির দৌড়ে কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের দৌড়ঝাপ ছিল চোখে পড়ার মতো। এক পাকিস্তান বাদে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশেই ভারত ভ্যাকসিন উপহার দিয়েছে।

চারিদিকে রমরমা আলোচনা ছড়িয়েছিল ভারতের ভ্যাকসিন কূটনীতি। হটাৎ করেই ভারতে ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। এরইমধ্যে ভ্যাকসিন কূটনীতির মাঠ কাঁপাতে হাজির হয়েছে রাশিয়া ও চীন। রুশ সরকার ৭০টি দেশে ভ্যাকসিন পাঠাতে চায়। এপ্রিলের মধ্যে চীন ৯০টি দেশে ভ্যাকসিন পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স বলছে, চীন ও রাশিয়া দরিদ্র দেশগুলোকে ডোজ দেয়ার মাধ্যমে ভ্যাকসিনের শূণ্যতা পূরণ করছে।

রাশিয়ার স্পুটনিক, চীনের সিনোভ্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ভ্যাকসিনের উৎপাদন ও সরবরাহ চ্যানেল তৈরিতে দেশগুলো কাজ করছে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়দেশই ভারতে অংশীদারের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে মিটিং করেছে। এখানে ভূটান ও ভারত অনুপস্থিত ছিল। এরইমধ্যে ভারতে ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া কোভিড মহামারি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি পৌঁছে দিয়েছে। রাশিয়ার সহায়তা আসায় মোদি রাশিয়ার সাথে ২+২ মিটিংয়ে বসার প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন।

এরআগে রাশিয়ার এই প্রস্তাবকে ভারত খুব একটা পাত্তা দেয়নি। কারণ ভারত কোয়াডভুক্ত দেশ। কোয়াড চীনবিরোধী জোট আর যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু দেশ রাশিয়া। রাশিয়ার এস-৪০০ ক্রয় নিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্র রেষারেষি চলছে। কিছুদিন আগে ফ্রিডম অফ নেভিগেশনের নামে ভারতের Exclusive Economic Zone অতিক্রম করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর। করোনায় বিধ্বস্ত দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্র কোভিড মোকাবেলায় প্রথমে এগিয়ে আসেনি৷ এসব কারণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি একটু হলেও রুষ্ট হয়। দ্য হিন্দু পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, করোনা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ দেশ দুটির সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে।

রাজনীতির খেলার মাঠ প্রতিনিয়তই টানটান উত্তেজনা জিইয়ে রাখে। কখন কে এখানে প্রধান খেলোয়াড় হয়ে গোল দিয়ে দেয় তা বলা মুশকিল। যেখানে কিছুদিন আগেও ভ্যাকসিন ভারতের অন্যতম সফট পাওয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল আজসেখানে দেশটিরই নাস্তানাবুদ অবস্থা। শশী থারুর লিখেছিলেন, ‘বিশ্বশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে ভ্যাকসিন কূটনীতি ভারতের জন্য একটা বর হয়ে দেখা দিয়েছে।’ এখন দেখা যাচ্ছে, ভারতের সেই আশায় গুড়েবালি। দেশটিকে বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

করোনা মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত চীনই সবচেয়ে বেশি সফল। মার্কিন বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি পর্যন্ত এ স্বীকৃতি দিয়েছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকা বলছে, চীনের লকডাউন পদ্ধতি বর্বরোচিত হলেও কার্যকরী ছিল। করোনায় ২য় ধাক্কায় চীনে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। দক্ষিণ এশিয়ায় ভ্যাকসিন কূটনীতিতে দেশটি সক্রিয় হচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার ভ্যাকসিন উৎপাদনে বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
সামনের দিনে ভ্যাকসিন বাণিজ্যে চীন ও রাশিয়া এগিয়ে থাকবে এমনটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভ্যাকসিন কূটনীতিতে এখন পর্যন্ত পিছিয়েই আছে।

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031