আবু হানিফ রাজধানীর মিরপুরে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতেন । ১৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন একটি কাপড়ের শোরুমে। কিন্তু লকডাউনে শোরুমটি বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে করোনার প্রকোপ বাড়ায় বেচাকেনা কমে যাওয়ায় বেতনও আটকে যায়। এ অবস্থায় চরম অর্থ সংকটে পড়েন তিনি। বাসা ভাড়া দিতে না পারায় ফ্ল্যাট ছেড়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে উঠেছেন একটি টিনশেড রুমে। জমানো কিছু টাকা আর ধারদেনা করে আপাতত কোনোমতে চলছে তার সংসার। একদিকে আয় বন্ধ, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের বাজার চড়া।
এমন পরিস্থিতিতে শহরে টিকে থাকা নিয়ে শঙ্কায় হানিফ। তিনি বলেন, মার্কেট খুললেও দোকানে বেচাকেনা তেমন নেই। মালিক লসের মধ্যে আছেন। লকডাউনের আগেই ১ মাসের বেতন বন্ধ ছিল। চলতি মাসের বেতন এখন পর্যন্ত হয়নি। হাতে যা টাকা ছিল কয়েকদিন বাজার সদাই করে সব শেষ। কারণ বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। এমনিতেই যা আয় করি তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। বেতনের বড় অংশ চলে যায় বাজার করতে। বাকিটা বাসা ভাড়ায় শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ব্যয় কমাতে ফ্ল্যাট ছেড়ে টিনশেড বাসায় উঠেছি। তারপরও যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তাতে ঢাকা শহরে টিকে থাকতে পারবো কিনা তা নিয়ে চিন্তায় আছি। শুধু হানিফ নন, করোনার কারণে একদিকে যেমন মানুষের আয়ে ভাটা পড়েছে, অন্যদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের কারণে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষেরা। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গিয়ে চোখে যেন সর্ষে ফুল দেখছেন হানিফের মতো এমন অনেক মানুষ। এ অবস্থায় চরম হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন কাটছে তাদের।
সম্প্রতি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট ‘ফরমাল রিকগনিশন অফ দ্যা উম্যান’স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক’ ফোরামের করা এক জরিপে বলা হয়, গত বছর থেকে করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে ৪৮.৪৯ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন করে কাজ হারিয়েছেন বা কাজ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন শহরের ৭৩.৩ শতাংশ এবং গ্রামের ৯২.৫ শতাংশ মানুষ। এই জরিপে সদস্য সংস্থা হিসেবে ছিল অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংস্থা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ, অক্সফাম এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।
গত শনিবার এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের মাধ্যমে ওই জরিপে তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে আরো বলা হয়, করোনার কারণে ৭৬ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে। মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করে এমন ৬৮ শতাংশের এবং ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করে এমন ৭৩ শতাংশ ব্যক্তির আয় কমেছে। শ্রমজীবী মানুষ বেশি আর্থিক সংকটে পড়েছে। নারীর কাজ না থাকায় ৭৭.৭৮ শতাংশ নারী প্রধান পরিবার অর্থনৈতিক অনটনে পড়েছে।
এমন অবস্থায় বাজারে নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে আরো চাপে পড়েছেন এসব মানুষ। গতকাল রাজধানীতে বসবাসরত স্বল্প ও মধ্য আয়ের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে একজন শফিকুল ইসলাম। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। লকডাউনে করোনাকালে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। এ অবস্থায় সংসার চালাতে নিজের মোটরসাইকেল দিয়ে ভাড়া টানতে শুরু করেন। তিনি বলেন, চাকরি চলে যাওয়ায় চরম হতাশার মধ্যে ছিলাম। পরে উপায় না পেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু লকডাউন ঘোষণা করায় আরেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পুলিশ ধরে ৫০০-১০০০ টাকা করে জরিমানা দেয়া শুরু করে। সেজন্য কয়েকদিন বাসা থেকে বের হয়নি। কিন্তু এভাবে তো সংসার চলে না। এখন আবার বের হয়েছি। তবে এখন কোনো অ্যাপসে রাইড শেয়ার করা যায় না। তাই চুক্তিতে চালাচ্ছি। প্রতিদিন খরচ বাদে ৬০০-৭০০ টাকা আয় হয়। এটা দিয়েই কোনোমতে জীবন চলছে। তিনি বলেন, যা আয় করছি সবটাই কেবল বাজার সদাই করতেই চলে যায়। কারণ বাজারে নিত্যপণ্যের দাম চড়া। দাম বেশি হওয়ায় অনেক কিছুই খাওয়া হয় না। আগে চিকন চাল খেতাম এখন আর খাই না। এখন মোটা চালের দামও বেশি। খালি চাল না, তেলসহ অন্যসব নিত্যপণ্যের দামই চড়া। যা আমাদের মতো মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এ অবস্থায় আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছি না।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, নিত্যপণ্যের চড়া দামে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এতে যেমন তাদের আয়ের সঙ্গেও ব্যয়ের ভারসাম্য থাকছে না, তেমনি সংসার চালানোই যেন তাদের পক্ষে দায় হয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই করোনার কারণে মানুষের আয়ে ভাটা পড়েছে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের মুখের হাসি যেন কেড়ে নিয়েছে।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রিকশাচালক আনোয়ার বলেন, যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। আগে দিনে ৬০০-৭০০ টাকা ইনকাম হতো। এখন তো ভাড়াই পাওয়া যায় না। সারাদিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। এই রোদ-গরমের মধ্যে রিকশা চালানোই মুশকিল। আবার রাস্তায় গেলে পুলিশ ধরে। কিন্তু সবকিছু বন্ধ হলেও সংসার তো বন্ধ করা যায় না। খাবার তো খেতে হয়। বউ-বাচ্চাদের খাওয়াতে হয়। কিন্তু যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোমতে ডাল-ভাত খেয়ে চলছে। বাজারে সবকিছুর দাম বেশি। শাক সবজি ছাড়া আর কিছু খাওয়ার সামর্থ্য আমাগো নাই। কিছু কিছু সবজির দামও বেশি। বাজারে গেলে মনে হয় সব যেন বড় লোকদের খাবার, আমাদের জন্য কিছুই নাই।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান মানবজমিনকে বলেন, করোনার কারণে মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়েছে। মানুষ ব্যবসা হারিয়েছে। এমনকি দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। সেই হিসেবে মানুষের আয় অনেক কমেছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে এসব মানুষ আরো সমস্যার মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে বর্তমানে চাল ও তেলের দাম বেড়েছে। এটা মানুষের জন্য খুবই কষ্টের। যে পরিমাণ তাদের আয় হচ্ছে তার সঙ্গে ব্যয়ের ভারসাম্য থাকছে না। ফলে অনেক মানুষ হতাশার মধ্যে রয়েছে।