মহাকাশ গবেষণায় সংকট বাংলাদেশে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১৬৯টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ৮৪ জন। শূন্যপদের সংখ্যা ৮৫টি। মোট পদের অর্ধেকেরও বেশি পদ শূন্য। এ রকম পরিস্থিতিতে চলছে প্রায় ১৫ বছর। কর্মরতদের মধ্যেও রয়েছে নানা হতাশা ও বাড়তি কাজের চাপের ক্ষোভ। এ চিত্র বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানে (স্পারসো)। এটি প্রযুক্তিভিত্তিক বহুমাত্রিক গবেষণা ও প্রয়োগ বিষয়ে একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান।
প্রতিষ্ঠানটির ম্যান্ডেট হচ্ছে- কৃষি, বন, মৎস্য, ভূতত্ত্ব, মানচিত্র অঙ্কন, পানি সম্পদ, ভূমি ব্যবহার, আবহাওয়া, পরিবেশ, ভূগোল, সমুদ্র বিজ্ঞান, শিক্ষা এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রে মহাকাশ ও দূর অনুধাবন প্রযুক্তিকে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা এবং উক্ত প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য গবেষণা কাজ পরিচালনা করা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অভিযোগ- রাষ্ট্রের এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এটি পড়ে রয়েছে অবহেলা আর নানা জটিলতায়। জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানটির চেইন অব কমান্ড প্রায় ভেঙে পড়েছে। মহাকাশ গবেষণাতেও নেই কোনো উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-মহাকাশ প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রয়োগ ও গবেষণা পরিচালনার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় স্পেস এজেন্সি হিসেবে স্পারসোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক্ষেত্রে স্পারসোর প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল, অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তিনটি কারণে স্পারসোতে শূন্যপদের সংখ্যা বেশি বলে এতে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় নিয়োগ না হওয়া, নিয়োগকৃত জনবলের বৃহদাংশের অবসরে যাওয়া ও নিয়োগকৃত জনবলের চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়া।
টানা ১৫ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো ধরনের নিয়োগ হয়নি। স্পারসোর লক্ষ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে-মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন এবং শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন তথা জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা। আর মিশন হিসেবে নেয়া হয়েছে-মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি, বন, সমুদ্র বিজ্ঞান, মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডল, পানি সম্পদ বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরিবীক্ষণ ও পূর্বাভাস প্রদান ও দেশে মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশে দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক। সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ভিশন ও মিশন এখন কেবলই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। এ প্রসঙ্গে স্পারসোর চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছি। মাত্র এক বছর আগে এখানে দায়িত্ব পেয়েছি। এসে জানলাম দীর্ঘ ১৫ বছর কোনো নিয়োগ হয়নি। আবার অনেকে ভালো চাকরি পেয়ে এখান থেকে চলে গেছেন। সবমিলিয়ে কষ্ট করে আমাদের চলতে হচ্ছে।
অফিস করতে হচ্ছে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাদের দায়িত্বের বাইরেও অতিরিক্ত কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছি। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি পদে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। আশা করি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটি। স্পারসোর নীতি নির্ধারণ ও পরিচালনার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাবান হলো স্পারসো বোর্ড। সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত ১ জন চেয়ারম্যান ও ৪ জন সদস্য সমন্বয়ে বোর্ড গঠিত। ১৬টি কারিগরি বিভাগ ও ৫টি সহায়ক শাখা এবং সাভারে অবস্থিত ১টি আঞ্চলিক দূর অনুধাবন কেন্দ্রের (জজঝঈ) সমন্বয়ে স্পারসোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা। বিশেষ করে রয়েছে অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততা। দূর অনুধাবন প্রযুক্তির প্রয়োগ ও ব্যবহারের জন্য রিয়েল টাইম ডাটা এক্যুজিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু স্যাটেলাইট হতে সরাসরি ডাটা রিসিভিংয়ের জন্য স্পারসোতে বর্তমানে কোনো কার্যকর স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন নেই। এদিকে স্পারসোর এক প্রতিবেদনে জাতীয় পর্যায়ে সেবাপ্রদান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-জন্মলগ্ন থেকে স্পারসো জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে অবদান রেখে আসছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত কারিগরি কমিটির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্পারসো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর স্বীকৃতি হিসেবে নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে স্পারসোর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দেশব্যাপী মৌজাভিত্তিক প্রথম ডিজিটাল মানচিত্র প্রণয়ন, যাতে ঘরবাড়ি, রাস্তা-ঘাট, পুকুর, জলাশয়, ধর্মীয় উপাসনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ মোট ২০টি থিমেটিক লেয়ার রয়েছে। উক্ত শুমারি মানচিত্রে ৫৬,৭৫৭টি ডিজিটাল মানচিত্র রয়েছে, যার ভিত্তিতে ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক বিভিন্ন শুমারির কাজ পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ল্যান্ড জোনিং প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় এলাকার ১৯টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলার ভূমি ব্যবহার মানচিত্র এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য বাংলাদেশের সকল প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার মানচিত্র প্রণয়ন করা হয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল এলাকার ভৌগোলিক স্থায়িত্ব বিশ্লেষণ করে।
কলাতলি সন্নিহিত এলাকায় প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনের স্থান নির্ধারণের জন্য সুপারিশ করা হয় এবং সে অনুযায়ী প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন স্থাপন করা হয়। অনুরূপভাবে কুয়াকাটায়ও দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশনের স্থান নির্ধারণের সম্ভাব্য জরিপ পরিচালনা করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৬৮ সালে পরমাণু শক্তি কমিশনে অটোমেটিক পিকচার ট্রান্সমিশন (এপিটি) গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপিত হয়।
১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রথম আর্থ রিসোর্সেস টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) উৎক্ষেপণের পরিপ্রেক্ষিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তি গবেষণার লক্ষ্যে ইআরটিএস প্রোগ্রাম এবং মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডল গবেষণা কেন্দ্র (এসএআরসি) চালু করা হয়। পরবর্তীতে ইআরটিএস ও এসএআরসি থেকে পর্যায়ক্রমে ১৯৮০ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অধীন স্পারসো প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন স্থানান্তর করা হয়।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২৯ নম্বর আইন দ্বারা স্পারসোকে সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে মহাকাশ সংক্রান্ত কার্যক্রমের জন্য স্পারসোকে ‘ন্যাশনাল ফোকাল পয়েন্ট’ নির্ধারণ করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৯শে মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য স্পারসো পরিদর্শন করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৮ সালের ৭ই ডিসেম্বর স্পারসো’র ট্রপিক্যাল ইকোসিস্টেম ম্যানেজমেন্ট শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনার উদ্বোধন করেন।