চট্টগ্রাম : সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তাকে প্রত্যাশিত বরাদ্দের ৫ শতাংশ দিতে না পারায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম অর্থবছরে (২০১৫–১৬) কাঙিক্ষত বরাদ্দ পাননি বলে জানিয়েছেন।
গতকাল বুধবার থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) মিলনায়তনে দিনব্যাপী আয়োজিত ‘নগর সংলাপ’ শীর্ষক এ অনুষ্ঠানে নগর পিতা আ জ ম নাছির উদ্দীন নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ইচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকা সত্বেও পদে পদে বাধা আর অসহযোগিতার কারণে আমি কাঙিক্ষত উন্নয়ন করতে পারি নি।
‘স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ শহর’ শীর্ষক নগর সংলাপ অনুষ্ঠানটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এলাকায় কর্মরত আন্তর্জাতিক, জাতীয় ও স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সমূহ যৌথভাবে আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট অর্থ (বরাদ্দের ৫ শতাংশ) দিতে হয় বলে মন্তব্য করে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। তিনি একটি নতুন পাজেরো জিপ চাইলেন। সেটি দিলে নাকি চসিকের প্রকল্প অনুমোদন বা পাসে কোনো সমস্যা হবে না। আমি কোথা থেকে জিপ দেবো? কেন দেবো? আমাকে বললেন– যত টাকা লাগে পাবেন, ৫ শতাংশ হিসাবে দিয়ে দিতে হবে। আমি বললাম– ৫ শতাংশ এটা কোত্থেকে আসবে? ঊনি বললেন–কন্ট্রাক্টরদের কাছ থেকে নিয়ে নিবেন এটা। আমি বললাম কন্ট্রাক্টররা আমাকে চোর মনে করবেন না? তারপর পত্রিকায় আসলে এটা কেমন হবে? ৫ শতাংশ এটা কিভাবে কাটবো। আমি কি তাহলে বলবো মন্ত্রণালয়ে দেওয়ার জন্য ৫ শতাংশ দিতে হবে এটা লিখে দিতে। ঊনি বললেন– সেটা করা যাবে না। আমি বললাম– আমি সেটা করবো না। তারপর আমাকে থোক হিসাবে ৮০ কোটি টাকা দেয়া হল। স্বাভাবিকভাবে দিতে হচ্ছে বলেই এই ৮০ কোটি টাকা দিল। আমি ৫ শতাংশ হিসাবে ছেড়ে দিলে, আমি যেটা চাইতাম সেটা দেয়া হত। অর্থাৎ ৩০০/৩৫০ কোটি টাকা আনতে পারতাম। টাকা দেই নি বলে সেটা পারি নি। এটাই হলো বাস্তবতা।’
মেয়র বললেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি এসেছিলেন। ঊনি আমাদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, তিনি সব কিছু করে দেবেন, ঊনাকে একটি গাড়ি দিতে হবে। কিন্তু তিনি (জয়েন্ট সেক্রেটারি) আমাকে ভয়ে কিছু বলেন নি। ঊনি যাওয়ার পরে প্রধান নির্বাহী আমাকে বললেন–স্যার, আসলে ঊনি আমাদের কাছে একটি গাড়ি চেয়েছেন। ঊনাকে গাড়ি দিলে মন্ত্রণালয়ের টাকা ছাড়ের সব ব্যবস্থা করে দেবেন।’ এ ভাবে দায়িত্ব পালনে পদে পদে বাধা আছে জানিয়ে পরিকল্পিত নগরী গড়তে নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান সিটি মেয়র।
চট্টগ্রাম নগর সংলাপ–২০১৬ ‘স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ শহর’ শীর্ষক সংলাপে মেয়র বলেন, আমরা আমাদের দেশকে সুন্দর করবো। পরিকল্পিত দেশে পরিণত করবো, সমৃদ্ধ করবো এই ধারণা প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে কাজ করলে তাহলেই সম্ভব পরিবর্তন করা। না হয়, সভা–সেমিনার হাজারো করলেও পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। মানুষ পরিবর্তন হলে, আইন আদালতও পরিবর্তন হবে।
আমলাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ে যিনি সিনিয়র এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি বসেন, তিনি মনে করেন তিনি পুরো বাংলাদেশের মালিক। এভাবে যেখানে যে বসে আছেন, সে–ই মনে করেন এই মন্ত্রণালয়ের বা চেয়ারে বা ডেক্সের মালিক ঊনি। ঊনার মাইন্ডে সেট হয়ে আছে পুরো বাংলাদেশের মালিক ঊনি।
মন্ত্রণালয়ের আচরণ হাত–পা বেঁধে সাঁতার কাটতে বলার মতো উল্লেখ করে মেয়র বলেন, ডোর টু ডোর ওয়েস্ট কালেকশনে গিয়েছি। কর্পোরেট হাউসের সহযোগিতা চেয়েছি। প্রায় ১০ লক্ষ বিন লাগবে। অনেকে আমাদের সাথে যোগাযাগ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছি। আগ্রাবাদ হোটেলে ডিনারের ব্যবস্থা করেছি। আলাদা আলাদা বসেছি। দুই মাস হয়েছে, কোন রেজাল্ট পাইনি। আমি তো ওদের জন্য বসে থাকতে পারবো না। লোকবলের প্রয়োজন আছে। লোকবল নিতে গেলে মন্ত্রণালয় বলে তোমার তো লোকবল নেওয়ার বিধান নেই। অর্গানোগ্রামের লোকবল অতিরিক্ত হয়ে গেছে।
মেয়র বলেন, বাড়ৈই পাড়া থেকে শাহ আমানত ব্রিজ পর্যন্ত খাল খনন মাস্টার প্ল্যানে আছে। সে অনুযায়ী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেটা অনুমোদন দিয়েছেন। প্রশাসনের অনুমোদন দিতে কয়েক মাস পার হয়ে যায়। এরপর কোয়ারির পর কোয়ারি আসছে। আমার প্রশ্ন– একনেক প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরও কেন এতো কোয়ারি আমার বোধগাম্য নয়। আগামী ২০১৭ সালের জুনে সেটার মেয়াদ শেষ হবে। আমাকে যারা পছন্দ করে না তারা বলবে আমি ব্যর্থ। আমার এখানে কি করার আছে? আমার যা যা করণীয় ছিল সবই তো আমি করেছি। মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় না করলে তো আমাদের করার কিছুই নেই।
জনপ্রতিনিধির কাজ করি দাবি করে মেয়র বলেন, সমাধান একটা জায়গায়– যদি মানুষের মধ্যে কোন ধরনের উপলব্দি তৈরি হয় তাহলে পরিবর্তন হবে। না হয় হবে না। আমার মনে হয় (একজন এনজিও প্রতিনিধির দিকে ইঙ্গিত করে) আপনাকে ওই চেয়ারে বসিয়ে দিলে আপনিও এমন হয়ে যাবেন। আমাদের ভয় আছে, আমাদের তো জনগণের কাছে যেতে হবে। আমাদের কাজ করার মানসিকতা আছে। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক আমরা কাজ করার চেষ্টা করি। জাতীয় পর্যায়ে নীতি–নির্ধারক যারা তাদের মধ্যে যদি পরিবর্তন আনতে পারেন; তাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করতে পারেন তাহলে পরিবর্তন আসবে।
আ জ ম নাছির বলেন, বাস্তবতার নিরিখে আমাদের কথা বললে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহজ হয়। নতুন শহরে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা সহজ। এই নগরে কতজন মানুষ বসবাস করবে। নগরে কি কি প্রয়োজন এগুলো পরিকল্পনা করে করা যায়। পুরাতন শহরকে পরিকল্পিত করা অনেক কঠিন। এখন নগর পরিকল্পনাবিদরা বলবেন শহরে এই করা উচিত, ওই করা উচিত। কিন্তু যখন করতে যাই তখন বুঝা যায় কত ধানে কত চাল। মেয়র বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশ চালাচ্ছেন, তিনি লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। কিন্তু প্রতিদিন ঊনার পক্ষে সব কাজ মনিটরিং করা সম্ভব নয়। এখানে যার কাজ যেটা সেটা তাকেই মনিটরিং করতে হবে। আমাদের এখানে আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। রয়েছে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার অভাব। যারা চায় তারা আরো বেশি বেশি চাই। যার কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। সবার মধ্যে আইন না মানার প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মেয়র।
তিনি বলেন, আলোচনা করা যায়, সমালোচনা করা যায়। আলোচনা–সমালোচনা অত্যন্ত সহজ বিষয়। আমার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি– এক বছর দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আমার সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু কেউ আন্তরিকতার ঘাটতি বা চেষ্টা করিনি সেটা বললে আমি মানবো না। আমি চেষ্টা করেছি।
এনজিওদের প্রতিবেদনে আপত্তি জানিয়ে মেয়র বলেন, আপনারা বলেছেন চট্টগ্রাম নগরে ২৫ লক্ষ মানুষ বসবাস করে। বাস্তবে এখানে ৪০ লক্ষ মানুষ বসবাস করে এবং আশপাশের আরো ২৫ লক্ষ মানুষ আসা যাওয়া করে। যেখানে প্রায় ১৯ লক্ষ ভোটার আছে; সেখানে ২৫ লক্ষ বসবাসকারী কিভাবে হয়।
খাল প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, এখন খাল নিয়ে কথা বলা হয়। কিন্তু খালের ভিত্তি কি হবে আরএস, বিএস নাকি সিএস। এটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এখনো সিদ্ধান্তই হয়নি কোনটি ভিত্তি হবে। এর মধ্যে অনেকগুলো দখল বেদখল হয়ে গেছে। আমরা গেলাম কিন্তু তারা আদালতের শরণাপন্ন হলেন। আদালত নিষেধাজ্ঞা দিলেন। তখন আমরা কি করবো? হাত–পা ঘুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই। আদালতের চূড়ান্ত আদেশ কখন আসবে একমাত্র রাব্বুল আলামিন ছাড়া কেউ সেটা বলতে পারবেন না। আবার মামলার জন্য টাকা ব্যয় হয়– সেটা কিভাবে করবো। ব্যয় করলে আবার অডিটে আপত্তি দেয়া হবে। এক কথায় কাজ করতে গেলে আমাদের পদে পদে সমস্যা।
চসিক এর সচিব মো: আবুল হোসেনের সভাপতিত্বে সংলাপে বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ. কে. এম. ফজলুল্লাহ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)- চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার সভাপতি প্রকৌশলী এম. আলী আশরাফ, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এর রিজিওনাল ফিল্ড ডিরেক্টর অঞ্জলী জাসিন্তা কস্তা ও ব্র্যাক এর পরিচালক কে. এ. এম. মোর্শেদ।
‘চট্টগ্রাম নগর সংলাপ ২০১৬’ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এডিপি ম্যানেজার শ্যামল ফ্রান্সিস রোজারিও এর স্বাগত বক্তব্যের পর নগর সংলাপে এর উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন ওয়ার্ল্ড ভিশন’র লিড আরবান প্রোগ্রামিং নূরুল আলম রাজু। নগর সংলাপের তিনটি আলোচ্য বিষয় ছিল ১) শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়ন, ২) পানি, পয়:নিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা এবং ৩) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা। নগর সংলাপে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি জেরিনা হোসাইন ‘শিশু সুরক্ষা ও উন্নয়ন’ শীর্ষক ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পুরাকৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. স্বপন কুমার পালিত ‘পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সৌরভ দাশ ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক উপজীব্য উপস্থাপন করেন। সংলাপের দ্বিতীয় পর্বে ছিল তিনটি ইস্যুর ভিত্তিতে দলীয় কাজ ও তার উপস্থাপন। সংলাপে অংশ নেন সাদার্ন ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপ উপাচার্য প্রকৌশলী মো. আলী আশরাফসহ চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, ডিপিএইচই প্রতিনিধি, উন্নয়ন সংস্থা প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিশু প্রতিনিধিসহ চট্টগ্রাম নগরে বসবাসরত বিভিন্ন পেশাজীবী প্রতিনিধি। নগর সংলাপে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আইনে ইঞ্জিনিয়ার–আর্কিটেক্টদের নকশা মোতাবেক কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের ফি নিয়ে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। ফি নিয়েও যদি তারা কাজ না করেন তাহলে কোথায় যাবে সরকার কোথায় যাবে সিডিএ। বিল্ডিং ঠিক জায়গায় করছে কিনা, কোন সমস্যা আছে কিনা এসব কি তারা দেখেন? বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবেন, আমি ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছি? এটা হলো বাস্তবতা।
তিনি বলেন, আজকে খাল, নালা, রাস্তা দখল করে ভবন উঠছে। আর্কিটেক্টরা যদি দায়িত্ব পালন করেন তাহলে সিডিএর প্রয়োজন নেই। এই শহর জঙ্গলের শহর, পরিকল্পিত শহর নাকি পরিকল্পিত বস্তি হবে সেটা সিডিএর উপর নির্ভর করবে। সরকার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছে। দায়িত্ববানরা যদি দায়িত্ব যথাযথ পালন করেন তাহলে শহর রক্ষা পাবে।
– See more at: http://www.dainikazadi.org/details2.php?news_id=1175&table=august2016&date=2016-08-11&page_id=1&view=0&instant_status=0#sthash.DDilYY3a.dpuf