‘আমাদেরকে সরকার আর্থিক কিছু সহযোগিতা করুক। লকডাউনে আমরা আর কতোদিন গাড়ি বন্ধ রেখে ঘরে থাকবো। কথা দিচ্ছি সাহায্য পেলে আমরা আর রাস্তায় বের হবো না।’ এমনটাই বলছিলেন ইজিবাইক চালক আজগর।
সর্বাত্মক বা কঠোর লকডাউনে সরকারি বিধি নিষেধ অমান্য করায় খানজাহান আলী থানা পুলিশ শতাধিক অটোরিকশা ও ইজিবাইক আটক করে থানায় জব্দ করেছে।
পুলিশ বলছে এ সকল যানবাহনের বিরুদ্ধে কোনো মামলা না হওয়ায় লকডাউন শেষে স্ব-স্ব চালকের নিকট গাড়িগুলোকে পুনরায় হস্তান্তর করা হবে।
জরুরি প্রয়োজনে গাড়ি নিয়ে বের হওয়া আটককৃত এ সকল অটোরিকশার ব্যাটারি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায়, সেগুলো ফেরত পেতে থানার সামনে অবস্থান নেয় আটককৃত গাড়ির চালকরা। আয়ের একমাত্র বাহন এভাবে নষ্টের হাত থেকের রক্ষা করতে একটিবার সুযোগ চান তারা। তারা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরিবারগুলোর বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে মুচলেকা দিয়ে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করে।
এদের মধ্যে ইজিবাইক চালক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমার বাড়ির সামনে থেকে আমার গাড়িটি পুলিশ আটক করে নিয়ে এসেছে। আমি অনেক অনুরোধ করে তাদেরকে বলেছি আমি যাত্রী বহনের জন্য গাড়ি বের করিনি, আমি ওষুধ আনতে শিরোমণি যাওয়ার জন্য বের হয়েছি। কিন্তু আমার কোনো কথা না শুনে তারা আমার ইজিবাইকটি থানায় নিয়ে আটকে রেখেছে।
এভাবে দু’তিন দিন থাকলে আমার গাড়ির ব্যাটারি ডাউন হয়ে গাড়িটি চালানোর অনুপযোগী হয়ে যাবে। প্রতিটি ব্যাটারির মূল্য প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা, আর এ ব্যাটারিগুলো নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় ব্যাটারি কেনার সামর্থ্য আমার নাই।’
মহেন্দ্র চালক আজগর জানান, মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান সাত জনের সংসারে উপার্জনের একমাত্র ব্যক্তি তিনি। একদিন গাড়ি না চালালে সংসার চলে না তারপরও লকডাউনে গাড়ি বন্ধ রেখেছিলেন। জরুরি প্রয়োজনে রাস্তায় নামতেই তার গাড়িটি পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। মোটরভ্যান চালক ইব্রাহিম বলেন, গরিবের কথা কেউ শোনেনা। বাসায় গেলে পরিবারের মানুষগুলো তাকিয়ে থাকে বাজার থেকে কি নিয়ে আসলাম। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে যা পাই তাই দিয়ে চাল-ডাল কিনে নিয়ে যাই। কিন্তু লকডাউনে আয় বন্ধ করে মরার পথ হয়েছে। এর উপর এভাবে ভ্যানটি আটকে রাখলে ভ্যানটি নষ্ট হয়ে যাবে। থানার সামনে অবস্থান নেয়া সকলে প্রথমবারের মতো মুচলেকা নিয়ে আটক ছোট যানগুলোকে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান।
এ ব্যাপারে খানজাহান আলী থানার অফিসার্স ইনচার্জ প্রবীর কুমার বিশ্বাস অটোরিকশা আটকের কথা স্বীকার করে বলেন, সর্বাত্মক লকডাউনে সরকারি আদেশ অমান্য করে যানবাহনগুলো যাত্রী বহন করায় তাদেরকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। লকডাউন শেষ হলে যানবাহনগুলোকে স্ব-স্ব ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ সকল ছোট যানবাহনের বিরুদ্ধে কোন মামলা করা হয়নি। আটককৃত অটোরিকশার ব্যাটারি যাতে নষ্ট না হয়ে যায়, সেজন্য যারা ব্যাটারি খুলে নিতে আসছে তাদেরকে আমরা ব্যাটারি দিয়ে দিচ্ছি।
খুলনা মহানগরীর পাঁচ নম্বর লঞ্চঘাট এলাকা। পাশেই গ্রীনল্যান্ড-ই ব্লকের বস্তি। এ বস্তিতে বাস করে শহরের নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা। কঠোর লকডাউনের কারণে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানবেতর দিন কাটছে তাদের। ২৮ বছর বয়সী দুই সন্তানের জননী হামিদা বেগম ৬ বছর থেকে বসবাস করছেন এই বস্তিতে। স্বামী আব্দুল হাই ৫নং ঘাটে কুলির কাজ করতেন। লকডাউনের কারণে কাজ নেই। এখন আমরা খাবো কি। বস্তির আরেক নারী রিনা খাতুন বলেন, স্বামী কুরবান সরদার লেবারী করেন।
লকডাউনের ফলে তার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। যে কারণে ৫ সদস্যের এই পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। রিনা খাতুনের পাশের ঘরটিতে বাস করেন রং মিস্ত্রি আব্দুর রহমান। তিনি জানান, লকডাউনের পর থেকে কাজ বন্ধ তার। কাজ করে কিছু টাকা গুছিয়ে ছিলেন, এখন গোছানো সেই টাকা দিয়েই সংসার চলছে। গত বছরের লকডাউনে ত্রাণ সহায়তা পেলেও এবারের লকডাউনে এখনো পর্যন্ত তা পাননি। একই অবস্থা ভ্যানচালক বাদশা মিয়ার। তিনি বলেন, মালামাল পরিবহনের কাজ করতেন একটি ফার্নিচারের দোকানে। মালামাল টানতে ভ্যান চালাতেন তিনি। কিন্তু লকডাউনের কারণে ফার্নিচারের দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ হারিয়েছেন। এখন অনেক কষ্টে সংসার চলছে তার।
হাফিজা বেগম নামে সিডিসি সংগঠনের এই এলাকার নারী নেত্রী জানান, ২১নং ওয়ার্ডের আওতাধীন এই বস্তিতে প্রায় ১৫০টি পরিবারের বসবাস। এখানে বসবাসকারী সকলেই শ্রম পেশার সঙ্গে জড়িত। লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া প্রতিটি পরিবারের অবস্থাই খুব খারাপ। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংগঠন ও সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা দিলেও এ বছর দুই ধাপে লকডাউনে এখনো পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি তারা। দিন এনে দিন খাওয়া এই মানুষগুলোর দিন কাটছে দীনহীন ভাবে।