রাজধানীর হাতিরঝিল দিয়ে কাওরানবাজার আসতে ফ্লাইওভারের পিলারে সাঁটানো পোস্টারের দিকে নিয়মিতই চোখ রাখি। কোনো পোস্টারই ২-৩ দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। তবে এখানকার পোস্টার থেকে জেনে নিতে পারি ঢাকায় নতুন কোন চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে। নতুন কোন পণ্য বাজারে এলো। রাজনীতিতে পা রাখতে চায় এমন কোনো নতুন মুখ এবং নতুন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম।

এভাবে পোস্টারে নজর রাখতে গিয়েই পরিচয় পিস স্কুলের সঙ্গে। স্কুলের নামটি পোস্টারে যেভাবে দেওয়া ছিল ডা. জাকির নায়েকের চ্যানেল পিস টিভির আদলে। অর্থাৎ টিভি চ্যানেল আর স্কুলের লোগো একই নকশার। এই সাদৃশ্য দেখেই বুঝতে পারি স্কুলে পাঠদান পদ্ধতি কেমন হবে, পাঠ্যক্রম সম্পর্কেও অনুমান করা গেছে। কিন্তু ঢাকায় পিস স্কুল আমার চোখে পড়েনি। শুনেছিলাম লালমাটিয়ায় এই নামে একটি স্কুল খোলা হয়েছে। যেখানে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া হয়, এই পর্যন্তই।

এর কয়েক দিন পর আমি দিনাজপুর যাই। শহর ঘুরে দেখতে গিয়ে পিস স্কুল চোখে পড়ে। স্কুলটির সাইনবোর্ড, দেয়াল লিখন, ব্যানারে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার কথা। পরে এর ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও দেখা হয়। তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং স্কুলের প্রসপেকটাস দেখে জানতে পারি এই স্কুলগুলোতে জাকির নায়েকের পিস টিভির আদলে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আরো জানতে পারি বাংলাদেশে পিস টিভি বা জাকির নায়েকের জনপ্রিয়তা দেখে তার নাম ও চ্যানেলের নাম ব্যবহার করে এই স্কুল ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে খোলা হয়েছে।

এর বেশ কিছুদিন পর দেশের একজন সম্মানিত স্কুল অধ্যক্ষ জানান, পিস স্কুলে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়, এখানে পড়লে ধর্মের জন্যই কাজ করা হবে এবং ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষ কাফের। এই স্কুলগুলোতে বাঙালি সংস্কৃতিরও চর্চা নেই। পিস স্কুল নিয়ে এরপর গণমাধ্যমে মৃদু কথা হলেও সরকার সেই মৃদু ভাষণে কর্ণপাত করেনি। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর যখন ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকার ঝাঁকুনি খেল তখনই পিস টিভির জাকির নায়েকের বক্তব্য জঙ্গিবাদকে প্ররোচিত করে এই অভিযোগ তোলা হয় এবং বাংলাদেশে এর সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংগতভাবেই পিস টিভির সঙ্গে পিস স্কুলের নাম চলে আসে। এ নিয়ে শিক্ষা ও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় ওঠে। পিস স্কুলের বাংলাদেশের সংস্কৃতিবহির্ভূত শিক্ষা এবং শিশুদের ধর্ম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রমাণ পাওয়া যায়। যার ফলাফল পিস স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা।

কিন্তু বন্ধ ঘোষণাকে কতটা তোয়াক্কা করছে পিস স্কুল কর্তৃপক্ষ, তার প্রমাণ মিলল পরদিনই। সরকারের ঘোষণার পরই অভিভাবকদের উদ্দেশে স্কুল থেকে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। যেখানে লেখা আছে, ‘অনিবার্য কারণবশত আমাদের স্কুলটি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার স্কুলটি বন্ধ রাখা হচ্ছে। ইনশা আল্লাহ আগামী রবিবার (৭ আগস্ট) থেকে স্কুল নতুনভাবে চালু হবে। অন্য এক খুদেবার্তায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আপনাদের জানাতে পেরে আনন্দিত যে, পিস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটির নাম পরিবর্তন করে সাউথ শোর নাম দেওয়া হয়েছে। স্কুলটির বই, ডায়েরিতেও দ্রুত নাম পরিবর্তন করা হবে।’

এর আগেই অবশ্য রাজশাহী থেকে খবর এসেছে সেখানে পিস স্কুলের নাম পরিবর্তন করে লিজেন্ড করা হয়েছে এবং সেই নামে স্কুলের কার্যক্রম চলমান। কোনো স্কুল বন্ধ হয়ে যাক, এটা প্রত্যাশিত নয়। কারণ পিস স্কুলের ১৭টি শাখায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুলের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষাবর্ষের মাঝপথে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন কোনো স্কুলে পাঠ্যক্রমে যুক্ত হওয়াও সহজ নয়। আর কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াই সমাধান নয়। মূল বিষয় হচ্ছে তদারকি। পিস স্কুলের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের প্রত্যক্ষ যোগাযোগেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে ত্বরিত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। কিন্তু রাজধানীসহ সারা দেশে যখন স্কুলটির প্রসার ঘটছিল তখন শিক্ষা বিভাগ চোখ বুঁজে ছিল কী করে?

এছাড়া দেশের দৃশ্যত চারধারার শিক্ষাব্যবস্থার অন্তরালে যে চৌদ্দমুখী শিক্ষা চলছে তার তদারকি করতেই বা কতটুকু সক্ষমতা দেখাতে পারছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর তার অধীনস্থ বিভাগগুলো। এত দিন ঢালাওভাবে কওমি ও অন্যান্য মাদ্রাসার বিরুদ্ধে অসহিষ্ণু ধর্মভিত্তিক শিক্ষার অভিযোগ দিয়ে আসা হচ্ছিল। সমাজের অগ্রসর বলে দাবিদার শ্রেণিটি ভেবেছিল তাদের সন্তানরা যেখানে শিক্ষা নিচ্ছে সেখানে এই প্রক্রিয়া মুক্ত। কিন্তু এখন সমাজের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেছে ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম বা অন্যান্য মিশ্র মাধ্যমের শিক্ষায় সন্তর্পণে ধর্মীয় শিক্ষার নামে উগ্রবাদ এবং দেশের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা- পরিচালিত হয়ে আসছে। যার শিকার হয়েছে আমাদের সন্তানরা। এ ধরনের শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের চেয়েও অধিক দায়ী করতে চাই রাষ্ট্রের শিক্ষাবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের।

স্বাধীনতার পর থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে এই জায়গায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন এই নীতিনির্ধারকরা। শিক্ষানীতি-কমিশনের একমুখী শিক্ষার সুপারিশকে দূরে ঠেলে রেখে তারা বরাবরই পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে মনোযোগী ছিল। যার ফলে শিক্ষা হয়ে উঠেছে পরীক্ষানির্ভর এবং তা শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমের বদলে কোচিংমুখী হতে প্ররোচিত করেছে। জ্ঞাননির্ভর শিক্ষার চেয়ে উপাত্তভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো হয়েছে। রাজধানী থেকে অজপাড়া গাঁ পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেন, প্রি-ক্যাডেট ও আরো রকমারি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, সেখানকার পাঠ্যক্রম কী? কোন দেশি বই পড়ানো হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের ইতিহাস নাকি অন্য কোনো দেশের ইতিহাস শেখানো হচ্ছে, ধর্ম শিক্ষার আড়ালে ছাত্রছাত্রীদের কিসে দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে, বাঙালি সংস্কৃতি সেখানে কতটা উপস্থিত? এখানে যারা শিক্ষা দিচ্ছেন, পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের পরিচয় কী?

এই দেখভাল বা তদারকি কতটুকু করেছে শিক্ষা বিভাগ বা রাষ্ট্র? করেনি বলেই প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সব স্তরেই মানহীনতা ও অশিক্ষার অস্বস্তি-অশান্তি। এই অশান্তি দূর করতে একের পর এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে নাগরিকদের প্রবোধ দেওয়ার সুযোগ নেই আর। এখন দূরে ঠেলে রাখা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট, শিক্ষানীতির ধুলো ঝেড়ে একমুখী শিক্ষা বাস্তবায়নে নেমে পড়তে হবে মাঠে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সার্বভৌম ও সংস্কৃতিবান্ধব নয় এমন শিক্ষা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে শান্তি দিতে পারে না।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031