চট্টগ্রাম : গত পাঁচ-ছয় দিন ধরে ক্রমেই বাড়ছে জোয়ারের উচ্চতা। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। আগ্রাবাদ ছাড়িয়ে বৃহত্তর হালিশহর, বন্দর, পতেঙ্গার শিল্প এলাকা, এমনকি দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জে ঢুকে পড়েছে জোয়ারের পানি। বৃহত্তর বাকলিয়া, চান্দগাঁও থেকে শুরু করে মহানগরীর বিশাল এলাকা ডুবছে এখন জোয়ারে পানিতে। মাথার ওপর তপ্ত সূর্য, গনগনে রোদ, কিন্তু রাস্তায় হাঁটুপানি। বৃষ্টি নেই তবু রাতে ও দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ভাসছে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ক্ষতি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ,বিনষ্ট হচ্ছে সড়ক, ইমারত। ব্যবসা ও বিনিয়োগে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।
কর্ণফুলী নদীর পাড়ে স্লুইস গেট না থাকা, নতুন বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করা ও কিছু স্লুইস গেট অকেজো হয়ে থাকায় জোয়ারের পানি এভাবে নগরে ঢুকে পড়ছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, পুকুর, দীঘি, জলাশয় ও নিচু ভূমি হারিয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
নগরবাসীকে এ থেকে মুক্তি দিতে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ এবং প্রতিটি খালের মুখে স্লুইস গেট বসানো হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামের ‘দুঃখ’ পানিবদ্ধতার অবসান হবে বলে প্রত্যাশা করছেন পাউবোর কর্মকর্তারা।
পাউবোর প্রকৌশলী সফিকুল জানান, পাহাড়, নদী আর সমুদ্রে ঘেরা চট্টগ্রাম নগরীতে একসময় অসংখ্য খাল ও ছড়া ছিল। অগণিত পুকুর, দীঘি, জলাশয় ও নিচু ভূমি তো ছিলই। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে এসব হারিয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে অসংখ্য খাল, নালা ও ছড়া। এ কারণে বৃষ্টির পানি যেমন সরে যেতে পারছে না, আবার জোয়ারের সময় প্লাবিত হচ্ছে মহানগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা।
জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে উল্লেখ করে পাউবোর প্রকৌশলী বলেন, “বিনষ্ট হচ্ছে সড়ক, ইমারত। হুমকির মুখে পরিবেশ জীববৈচিত্র্য। জোয়ারের কারণে মহানগরীর কিছু কিছু এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে যারা এসব এলাকায় থাকছেন, তাদের পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় সগর্বে দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। সেই আগ্রাবাদ জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগেও।
এ ছাড়া চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ-আসাদগঞ্জের মতো বাণিজ্যিক এলাকাতেও গত কয়েক বছর ধরে জোয়ারের পানি হানা দিচ্ছে। আড়ত,, গুদাম ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে শত শত কোটি টাকার পণ্য বিনষ্ট হচ্ছে। দিনে দুবার জোয়ারের কারণে ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহন।
নগরীর খাতুনগঞ্জের আড়তদার হাজি মো. সেলিমুল হক জানান, চাক্তাই খাতুনগঞ্জের প্রায় চার হাজার দোকান ও আড়ত দিনে দুবার জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় বলে মার খাচ্ছে শত কোটি টাকার ব্যবসা।
সেলিমুল হক জানান, জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশন নগরীর নালা-নর্দমা-খাল পরিষ্কার করলেও স্লুইস গেটগুলো অকেজো হয়ে পড়ায় তেমন সুফল মিলছে না। বৃষ্টির পানি যেমন এসব স্লুইস গেট দিয়ে সহজে নামতে পারে না, তেমনি জোয়ারের পানি প্রবেশ করলে তা আটকে গিয়ে ডুবিয়ে দিচ্ছে নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকা।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একসময় জোয়ারের পানি ঢুকে খাল, নালা ও নিচু ভূমিতে চলে যেত। কিন্তু এখন খাল, নালা, নিচু ভূমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারের পানি আবাসিক এলাকা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সড়কে উঠে আসছে। মহানগরীর বেশিরভাগ খাল মিলিত হয়েছে কর্ণফুলী নদীতে। এসব খালের অধিকাংশের মুখে কোনো সøুইস গেইট নেই। যেগুলোতে আছে সেগুলো অকেজো।
পাউবো সূত্র জানায়, ১৯৬০-এর দশকে হালিশহর ও কাট্টলী এলাকায় কিছু স্লুইস গেট বসানো হয়। মূলত চাষাবাদের জমি রক্ষা করার জন্য বেড়িবাঁধ ও খালের মুখে তখন ওসব স্লুইস গেট দেয়া হয়েছিল। তা ছাড়া সাগরতীরে বেড়িবাঁধ থাকলেও কর্ণফুলী নদীর পাড়ে কোনো বাঁধ নেই। এ কারণে জোয়ারের পানি মহানগরীতে ঢুকে পড়ছে। এ অবস্থায় মহানগরীর খালের মুখে স্লুইস গেট বসিয়ে জোয়ারের পানি আটকানো ছাড়া জোয়ার-ভাটার কবল থেকে মহানগরীকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
এ প্রেক্ষাপটে একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে হাঁটছে সরকার। এতে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার এ প্রসঙ্গে ঢাকাটাইমসকে বলেন, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। কিছু প্রক্রিয়া শেষে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। কালুরঘাট থেকে পতেঙ্গা সৈকত পর্যন্ত নতুন করে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে। এর মাধ্যমে জোয়ারের পানি আটকানোর ব্যবস্থা করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকাল সাত বছর ধরা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসা বন্ধ রেখে রাস্তায় ব্যবসায়ীরা
দেশের ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ে জোয়ারের পানি ও জলাবদ্ধতা থেকে রেহাই পেতে সম্প্রতি রাস্তায় নামেন ব্যবসায়ীরা। সাত দফা দাবিতে তারা মানববন্ধন করেন।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমতির ব্যানারে দোকানপাট, গুদাম, আড়ত বন্ধ রেখে শত শত ব্যবসায়ী ও শ্রমিক চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও কেরানিগঞ্জ এলাকায় বিশাল এ মানবন্ধন করেন। মানববন্ধনে অংশ নেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও।
ব্যবসায়ীরা এ সময় মেয়রের কাছে সাত দফা লিখিত দাবি পেশ করেন। সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ সোলায়মান বাদশা দাবিগুলো পড়ে শোনান।
সাত দফা দাবি হলো- কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা। খাতুনগঞ্জ প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা। খালগুলোতে আধুনিক স্লুইস গেট নির্মাণ করা যাতে নৌকা নিয়ে মালামাল আনা-নেয়ায় কোনো বাধা সৃষ্টি না হয়। জঙ্গিবাদমুক্ত নিরাপদ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে খাতুনগঞ্জে গণশৌচাগার স্থাপন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করতে একটি কমিউনিটি হল নির্মাণ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ রাখা।
ব্যবসায়ীদের দাবির প্রতিক্রিয়ায় সিটি করপোরেশন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন ও নদী খননের দাবি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে জানানো হবে। আশা করছি অতি দ্রুত সমস্যাগুলো সমাধান হবে।