জরাজীর্ণ কাপড়। উষ্কখুষ্ক চুল। বয়স পনেরো কি ষোলো। পায়ে ছিঁড়া স্যান্ডেল। পুরো দেহে দারিদ্র্যের ছাপ। এই বেশে কাউকে চোখে ইশারা দিচ্ছে আবার কাউকে ডাক দিচ্ছে। একটু এগিয়ে গেলেই জানতে চায় কতটি লাগবে? এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে- একটি লাগবে বলে জানান। পরে ওই কিশোরী তার জামার ভিতর পকেট থেকে দু’টি প্যাকেট বের করে দেয়।

জিজ্ঞাসা করে কোনটি নিবেন? ওই প্যাকেট দু’টিতে ছিল দুই ধরনের ত্রিশ-চল্লিশটি ইয়াবা। একটির দাম ৩৫০, আরেকটি ৪৫০ টাকা। কিশোরীর কাছে জানতে চাওয়া হয়- এই ইয়াবাগুলো কোথা থেকে নিয়ে আসা হয়? কার থেকে নিয়ে আসে? এমন প্রশ্নে সন্দেহ হলে কিশোরীটি দৌড়ে স্থান ত্যাগ করে। এই দৃশ্য কাওরান বাজার রেলগেট এলাকার। গত বুধবার বিকাল ৩টা। কাওরান বাজার রেলগেট থেকে এফডিসির পথ ধরে হাঁটা শুরু করি। এফডিসি রেলগেট পর্যন্ত যেতে সময় লাগে ঘড়ির কাঁটায় ৮ মিনিট। এই পুরো ৮ মিনিটে ১৮ জন খুচরা ইয়াবা বিক্রেতার ডাক পাওয়া যায়। যাদের সবার কাছেই ইয়াবা ছিল। এর মধ্যে ১০ জনই ছিল কিশোরী। বাকি ৮ জন নারী। এসব নারী ও কিশোরী শরীরের ঊর্ধ্বাংশে লুকিয়ে রাখে ইয়াবা ট্যাবলেট। আর কোমরের সঙ্গে বাঁধা কাপড়ের বিশেষ ব্যাগে রাখে কাগজে মোড়ানো গাঁজা। আর ঘরে রাখে ফেনসিডিল বা হেরোইন। তবে ক্রেতাদের চাহিদা বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট।

পরের দিন বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা। একই জায়গায় একঘণ্টা সময় পর্যবেক্ষণ। উদ্দেশ্য কারা কিনতে আসছে এসব ইয়াবা। এক ঘণ্টায় দেখা গেল- অর্ধশতাধিক তরুণের আনাগোনা। তাদের উদ্দেশ্য ইয়াবা। তাদের বেশিরভাগ ক্রেতাকে আগে থেকে চিনে এসব বিক্রেতারা। তাই দামাদামি বা বেশি সময় নেয় না। মাত্র মাদক কিনেছেন- এমন একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে তার আরো দুই বন্ধু। তারা তিনজনই শুক্রাবাদ একটি বাসায় থাকেন। তাদের একজন বলেন, আমরা সপ্তাহে দুই-তিন দিন আসি। যখনই টাকা জোগাড় হয় তখনই আসা হয়। তারা তিনজনই পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করান। তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে সবাইকে আমরা চিনি। এখানকার বেশিরভাগই বাচ্চা মেয়ে। তারা নিয়মিত ইয়াবাসহ গাঁজাও বিক্রি করে। আমরা মূলত ইয়াবা নিয়ে থাকি। তবে এসে দ্রুত নিয়ে চলে যাই। বেশিক্ষণ থাকি না।
এদিকে দেখা যায়, বিকালে আসা বেশিরভাগ ক্রেতাই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তাদের ভাষ্য, এই এলাকায় কম দামে ইয়াবা পাওয়া যায়। পরের দিন শুক্রবার সকাল ১০টা। সকালে আবার সরজমিনে দেখা যায় একই দৃশ্য। তবে ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। সকাল বেলায় মধ্যবয়সী পুরুষদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। তারা মূলত কাওরান বাজারের দিনমজুর বা শ্রমিক।

তিনদিনে সরজমিনে দেখা যায়, সকালের ক্রেতা সাধারণত ৩০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরা আর বিকালের ক্রেতা ছাত্র-যুবক। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে। রাজধানীর কাওরান বাজার। সারা দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট হিসেবেই পরিচিত এই বাজারটি। এর পাশেই রেল লাইন ও তেজগাঁও বস্তি। এই তিনটি জায়গায় গড়ে উঠেছে আরেক বাজার। ইয়াবার বাজার। প্রকাশ্যে ইয়াবার পাশাপাশি এখানে অন্য মাদকও বিক্রি হয়। তবে অল্প পুঁজিতে বেশি চাহিদা থাকার কারণে ইয়াবাই বেচাবিক্রি হয় বেশি। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কাওরান বাজার বস্তি ও রেল লাইনের ত্রিশ, ৪০ জন কিশোরী। যাদের বয়স ১২ থেকে ১৮-এর নিচে। যদিও এর বাইরে আরো শতাধিক নারী জড়িত ইয়াবা ও মাদক বিক্রির সঙ্গে। একজন সাধারণ পথচারী হিসেবে যে কেউই কাওরান বাজার রেললাইন ধরে হাঁটলেই ডাক পড়বে এই কিশোরীদের।

এদিকে তেজগাঁও বস্তি, কাওরান বাজার, রেলগেট ও ফার্মগেটের কিছু অংশে কিশোরীদের ঘুরে ঘুরে ইয়াবা ও গাঁজা বিক্রির দৃশ্য চোখে পড়ে। কিশোরীদের বাইরেও এসব বিক্রি করছেন নারী সদস্যরা।
কাওরান বাজার এইচআরসি বিল্ডিংয়ের সামনে এক কিশোরীর সঙ্গে কথা হয়। নাম বলতে অনিচ্ছুক ওই কিশোরী বলে, কাওরান বাজার এলাকায় আমাদের মতো অনেক মেয়ে আছে যারা ইয়াবা বেচে, গাঁজা বেচে। কেন এসব বিক্রি করে এমন প্রশ্নে ওই কিশোরী বলে, আমাদের কেউ কাজ দেয় না। পড়াশোনা নেই। যার কারণে পেটের দায়ে এসব বেচতে বাধ্য হই। প্রতিদিন আমি বিশ-পঁচিশটি ইয়াবা বিক্রি করতে পারি। এতে ৬-৭শ’ টাকা লাভ হয়।
এদিকে এমন কয়েকজন কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ কিশোরীরই পরিবার পরিজন নেই। তাদের অনেকেই আবার নিজেও আসক্ত এসব মাদকে। তবে তাদের বেচাবিক্রির ধরন একটু ভিন্ন। এসব কিশোরীর মধ্যে নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করা থাকলেও যে যার ইচ্ছামতো ঘুরে ঘুরে মাদক বিক্রি করতে পারে।

কাওরান বাজার ওয়াসা ভবনের পাশে এক যুবককে ইয়াবা কিনতে দেখা গেছে। একটু এগিয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, বাবা কিনেছি। আপনার এতো জানার দরকার কি? এসব বলে তিনি আর কথা বলতে চাননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, মাদক একটি জীবন শেষ করে দেয়। তার ওপর যদি অপ্রাপ্ত বয়স্করা মাদক বেচাবিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তাহলে পরিণাম হয় খুব ভয়ঙ্কর। তাদেরকে চিহ্নিত করে পুনর্বাসন এবং কিশোর সংশোধনাগারে দেয়া উচিত।

তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সালাহ উদ্দিন মিয়া ইয়াবা বিক্রির বিষয়টি স্বীকার না করলেও অন্যান্য মাদক বিক্রির বিষয় স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কিশোরী ও কয়েকজন নারীর গাঁজা বেচার তথ্য আছে আমাদের কাছে। তাদেরকে আমরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে আবার বের হয়ে তারা একই কাজে নেমে পড়ে। ইয়াবার ব্যাপারে তিনি বলেন, এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এখন আমরা খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নিবো।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031