নিরাপদ জার্নি ট্রেন জার্নিকে মনে করা হয় । কিন্তু সিলেটের বেলায় এ কথা ঠিক উল্টো। সিলেটবাসীর জন্য ট্রেন জার্নি নিরাপদ নয়, বরং মৃত্যুফাঁদ। সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেলপথ, ব্রিজ কালভার্ট এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে- যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। এ কারণে আতঙ্কের রুট হয়ে দাঁড়িয়েছে সিলেটের রেলপথ। বৃটিশ আমলে নির্মিত এই রেলপথকে সংস্কার আধুনিক করতে এখনো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তবে- বর্তমান সরকার সিলেট থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রেললাইনকে ডাবল করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে সিলেটের মন্ত্রীরা এ সংক্রান্ত ডিও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছেন।

কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালের ২৪শে জুন বরমচালের ট্রেন দুর্ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার রাতে বরমচালের নিকটবর্তী স্থান গুতিগাঁওয়ে ঘটে আরেকটি ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় তেলবাহী ট্রেন পতিত হওয়ায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। সরকারি সম্পদের অপচয় হয়েছে। বিশেষ করে কয়েক কোটি টাকার তেল নষ্ট হয়ে গেছে। রেললাইন, ট্রেনের বগিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বরমচালের ঘটনা নাড়া দিয়েছিল সিলেটবাসীকে। ওই দুর্ঘটনায় কয়েকজন যাত্রী নিহত হওয়া ছাড়াও আহত হয়েছিলেন শতাধিক। কয়েকটি কারণে সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ঘটছে দুর্ঘটনা। এরমধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে- শতাধিক বছরের পুরনো রেলপথ। এই রেলপথ এখন জরাজীর্ণ। বরমচাল ও গুতিগাঁও এলাকার লোকজন মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত রেলপথটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। লাইন আছে, কিন্তু অনেক স্থানে নেই নাটবল্টু। জরাজীর্ণ হওয়ার কারণেই নাটবল্টু ছিটকে পড়ে গেছে। ১০-১২টি কালভার্ট ও ব্রিজও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এই ব্রিজ ও কালভার্টের বেশির ভাগই সংস্কারহীন অবস্থায় রয়েছে। কোথাও স্টিলের বদলে বাঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে মালবাহী কিংবা যাত্রীবাহী ট্রেন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। বরমচালের ঘটনার আগের স্থানীয়রা রেলপথ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এলাকার মানুষ রেলওয়ের স্থানীয় কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানালেও তারা নজর দেয়নি। ঠিক এমন ঘটনা ঘটেছে ফেঞ্চুগঞ্জের গুতিগাঁওয়ে। গত বৃহস্পতিবারের ঘটনার আগে এলাকার লোকজন রেললাইনের অবস্থা দেখে কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন। ফেঞ্চুগঞ্জ পাড়ি দিলেই রেলপথ ঢুকে যায় পাহাড়ি এলাকা। আঁকাবাঁকা রেলপথ। এই অবস্থায় এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ এ সড়ক। তার ওপর রেললাইন নাজুক হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তেলবাহী ট্রেন দুর্ঘটনার পর রেলের সিলেট বিভাগীয় ব্যবস্থাপক সাদিকুর রহমান জানিয়েছেন- গুতিগাঁওয়ের ব্রিজের উপর রিলিফ ট্রেন রেখে বগি তোলাটা ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। এ কারণে তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করছেন। এলাকার কয়েকজন যুবক জানিয়েছেন- গুতিগাঁওয়ের যে রেল ব্রিজ রয়েছে সেটির অনেক স্থানে স্টিলই নেই। বাঁশ দিয়ে দেয়া হয়েছে জোড়াতালি। আর এর উপর দিয়ে চলছে রেলগাড়ি। ফলে দুর্ঘটনা ঘটবে না সেটি বলা যাচ্ছে না। এখনো গুতিগাঁও এলাকায় রেল চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ। বাস্তব হচ্ছে- রেলওয়ের স্থানীয় কিংবা সিলেটের কর্মকর্তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করছেন বলে জানান তারা। সিলেট-আখাউড়া রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ১৩টি সেতু মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। রেলওয়ের তালিকায় থাকা এই ১৩টি সেতুর উপর ট্রেন পারাপারে ‘ডেড স্টপ’ ঘোষণা করা হয়েছে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি এবং মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে পাঁচটি সেতু ‘ডেড স্টপ’ এর আওতাধীন। রেলওয়ে সূত্র জানায়- সিলেট-আখাউড়া সেকশনের ঝুঁঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে শমসেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯নং সেতু এবং মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। সেতু সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এগুলো সংস্কার হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এর বাইরেও অনেক স্থানে রেলপথের অবস্থাও নাজুক। এই নাজুক সড়ক পথের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনাও। এদিকে- এই দুর্ঘটনার আগে থেকেই সিলেটের তিন মন্ত্রী সিলেট-আখাউড়া রেলপথ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পত্র দিয়েছিলেন। এই পত্রের প্রেক্ষিতে সিলেট থেকে আখাউড়া রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করার একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রতি সিলেট সফরে এসে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সিলেট থেকে আখাউড়া রেলপথ নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন। একই সঙ্গে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ করার বিষয়টি তিনি জানিয়েছেন। সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার খলিলুর রহমান মানবজমিনকে জানিয়েছেন- রেল দুর্ঘটনা ঘটলেই যাত্রী দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। গত বৃহস্পতিবার রাতের দুর্ঘটনার পরও দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছিল। রাস্তা সংস্কার হওয়ার পর পরই রাত ৩টা থেকে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক করা হয়েছে। এখন ট্রেনের শিডিউল ঠিক রাখতে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031