সারা দেশে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আজ থেকে ভ্যাকসিন যুদ্ধ শুরু হচ্ছে । উদ্বোধনের ১০ দিন পর আজ সকাল থেকে দেশের ১০০৫টি হাসপাতালে স্থাপিত কেন্দ্রে টিকা দেয়া শুরু করবেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। প্রথম দিন ঠিক কতো জনকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে এমন কোনো তথ্য জানানো হয়নি। কারা ভ্যাকসিন পাবেন তাও স্পষ্ট নয়। প্রথম দিন যারা ভ্যাকসিন পাবেন তাদের শনিবার রাতের মধ্যে এসএমএস দিয়ে জানিয়ে দেয়ার কথা বলা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফে। সরকার প্রথম মাসে ৩৫ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার পরিকল্পনা করেছে। সে অনুযায়ী প্রতিদিন এক লাখের বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে।
গতকাল বিকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন এসব তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম।
তিনি আরো জানান, টিকা নিতে গতকাল বিকাল আড়াইটা পর্যন্ত ৩ লাখ ২৮ হাজার ১৩ জন নিবন্ধন করেছেন। কার্যক্রমের প্রথম দিনেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী টিকা নেবেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও টিকা নেবেন বলে জানানো হয়েছে। নির্ধারিত কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত ভ্যাকসিন দেয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, ঢাকাসহ সারা দেশের এক হাজার ৫টি হাসপাতালে ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকা প্রদান কার্যক্রম একযোগে শুরু হচ্ছে। ঢাকায় ৫০টি হাসপাতালে ২০৪টি দল ভ্যাকসিন দিতে কাজ করবে। ঢাকার বাইরে ৯৯৫টি হাসপাতালে কাজ করবে ২ হাজার ১৯৬টি দল। দেশের সব উপজেলায় ভ্যাকসিন পৌঁছে গেছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যারা নিবন্ধন করতে পারেননি তারা টিকাকেন্দ্রে এসে নিবন্ধন করতে পারবেন। তবে মোবাইল ফোনে এসএমএস পাওয়ার পর ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হয়েছিল যারা ভ্যাকসিন নেবেন তাদের জানানো হয়েছে কিনা। জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তরফে বলা হয়, গতকাল শনিবার রাতের মধ্যে তারা মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা পাবেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানান, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী টিকা নেবেন। টিকা নেয়ার আগে সকাল ১০টায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যালয়ে এসে সারা দেশের কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কথা বলবেন। তারপর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে গিয়ে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হবে।
খুরশীদ আলম বলেন, গতকাল যেসব কেন্দ্র ঘুরে দেখা হয়েছে, সব কেন্দ্রে প্রস্তুতি ভালো আছে। আমরা আশা করছি, কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই আমরা টিকাদানের কাজ শুরু করতে পারবো। কিছু কিছু ছোট কেন্দ্রে বিশেষত মাতৃসদন, শিশু কেন্দ্রগুলোতে আমাদের কিছুটা প্রস্তুতির ঘাটতি আছে। এটা সকাল বেলার কথা। আশা করি সন্ধ্যার মধ্যে আমরা এই ঘাটতি সম্পন্ন করতে পারবো। আমরা এখানে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবো এবং সব কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করবো। তারপর যেখানে যে সমস্যা আছে আমরা এখান থেকে সমাধান করার চেষ্টা করবো।
তিনি আরো জানান, প্রধান বিচারপতি শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেবেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব তোফাজ্জল হোসেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিন্স) হাসপাতালে টিকা নেবেন। কেবিনেট সচিব টিকা নেবেন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি কেন্দ্রে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টিকা নেবেন সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে টিকা নেবেন। ডিজি বলেন, বিভিন্ন জেলায় এবং বিভিন্ন জায়গায় সংসদ সদস্যরা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং স্থানীয় যেসব গণ্যমান্য ব্যক্তি আছেন তারা ওই সব কেন্দ্রে সম্পৃক্ত থাকবেন এবং টিকা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য তারা টিকা নেবেন ও কার্যক্রমে সহযোগিতা করবেন।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা জানান, টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধনের সময় যে ৫৬৭ জন ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন তাদের সবাই সুস্থ আছেন। জটিল কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। দু’দিনে নেয়া জটিল কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি, সবাই সুস্থ হয়েছে। তাদের এক ভাগের জ্বর হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, টিকায় এখন আর কোনো ধাপ নেই, টিকা চলমান প্রক্রিয়া। গর্ভবর্তী ও প্রসূতি মা, করোনা সেরে উঠার ৪ সপ্তাহ পার এবং জটিল রোগে আক্রান্তদের ভ্যাকসিন নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতার অবলম্বনের পরামর্শ। টিকার মেয়াদ প্রসঙ্গে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মওয়ালা বক্স চৌধুরী এ সময় বলেন, যে টিকা হাতে এসেছে তার মধ্যে একটি ব্যাচের মেয়াদ এপ্রিল এবং অপর ব্যাচটির জুন মাসে মেয়াদ শেষ হবে।
দেশে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে উপহার পাওয়া ২০ লাখ ডোজ টিকা আসে ২১শে জানুয়ারি। এরপর ২৫শে জানুয়ারি ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ৫০ লাখ ডোজের প্রথম চালান দেশে আসে। চুক্তি অনুযায়ী ৩ কোটি টিকা আসবে দেশে। প্রতি মাসে কেনা ৫০ লাখ করে টিকা আসার কথা রয়েছে। কোভ্যাক্সের আওতায় বাংলাদেশ যে টিকা পাবে, তার প্রথম চালান আগামী এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে পৌঁছাতে পারে। জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হিসাবে কোভ্যাক্স থেকে প্রায় ৭ কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে। সংস্থাটি থেকে প্রথম ধাপে আসবে প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখ ডোজ টিকা। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, দেশে ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভ্যাকসিন আনছে দেশের শীর্ষ ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মা। বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে সারা দেশের এই ভ্যাকসিন পৌঁছে দেয়া হয়।
১০ মাসে সর্বনিম্ন শনাক্ত: এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩০৫ জন করোনা শনাক্ত হয়েছেন। গত বছরের ১৯শে এপ্রিল শনাক্ত হয়েছিলেন ৩১২ জন। এরপর আর এতো নিচে নামেনি শনাক্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত দেশে শনাক্ত হয়েছেন মোট ৫ লাখ ৩৭ হাজার ৭৭০ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন আট হাজার ১৯০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয় ১১ হাজার ৯৩৫টি, অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয় ১২ হাজার ১৩৫টি। এখন পর্যন্ত ৩৭ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৪১৭ জন, এখন পর্যন্ত সুস্থ ৪ লাখ ৮২ হাজার ৮৪১ জন। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার গত ২৪ ঘণ্টায় ২ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং মারা গেছেন ১ দশমিক ৫২ শতাংশ। উল্লেখ্য, দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ই মার্চ আর ভাইরাসটিতে প্রথম মৃত্যু হয় ওই বছরের ১৮ই মার্চে।