গণপ্রজাতন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় একটি রাজনৈতিক শক্তির লালিত ইচ্ছার বহি:প্রকাশ হিসাবে। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তির গঠন সম্পর্কে আলোচনা ও গবেষণা হয়ে থাকে সাধারণত রাজনীতি বিজ্ঞানে। তবে ভাষা বিজ্ঞানেও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক গঠন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়ে থাকে।
মুসলিম লীগের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রভুক্ত বিভক্ত বাঙ্গালী জাতি জাতীয়তাবাদে উদ্দীপ্ত হয়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। আর পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছিলো ব্রিটিশ সরকারের আনুগত্যে লালিত ও প্রতিষ্ঠিত অভিজাত মুসলমান সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণির হাত ধরে। এই মুসলিম অভিজাত শ্রেণি ব্রিটিশ রাজনৈতিক শক্তিকে তোষণের ফলে ব্যবসা, জমিদারি এবং সামরিক ও বেসামরিক চাকরি-বাকরি লাভ করে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ উপনেবিশবাদ বিরোধী সংগ্রাম চলাকালে এই মুসলিম অভিজাত শ্রেণি মুসলিম লীগের মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে, ইণ্ডিয়ান ন্যাশানাল কংগ্রেসের সাথে দেন-দরবার করে ভূখণ্ড বিভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টি করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপর মুসলমান অভিজাত শ্রেণি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে এবং তারা পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা, শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে মনযোগী হয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়তে থাকে। কাজেই বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে) সৃজ্যমান অভিজাত শ্রেণি রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসাবে পাকিস্তানের উর্দু ভাষাভাষী রাজনৈতিক শক্তির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে শোষণের চিত্রটি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়। তারা জন-মানুষকে ভাষার অধিকার সম্পর্ক সচেতন করে তুলে। দেশব্যাপী তখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়; যদিও সে সময় বাঙ্গালী জাতি বলতে যাদের বুঝায়, তাদের একটি বড় অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এবং এখনও আছে। সৃজ্যমান এই রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে, বাংলা ভাষার মর্যাদা ও প্রায়োগিকতা সম্পর্কে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, এই সৃজ্যমান মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক শক্তি ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। কিন্তু তারা বংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের প্রশ্নে কিছু করেনি বরং এই সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণি ভাষা হিসাবে ইংরেজিকে গ্রহণ করে। এই সৃজ্যমান নতুন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণি ক্রমান্বয়ে বাংলা ভাষার পক্ষের অবস্থান থেকে সরে আসে।
যদিও এ রাষ্ট্রটি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্দীপিত হয়ে গঠিত হয়, তা সত্ত্বেও পশ্চাৎপদ রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুযোগে এখন স্থায়ী শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা সম্বলিত রাষ্ট্র সৃজনের এগিয়ে দিকে যাচ্ছে। কাজেই দেশের যেখানে যেখানে অর্থ প্রবাহ রয়েছে সেখানে সেখানে জনগণের অর্থ আত্মসাতের ব্যবস্থা স্থায়ী হয়েছে। দেশে যদিও একটি নির্বাচন ব্যাবস্থা রয়েছে, এটি কার্যকর নয়। যে কারণে স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তসমূহ অভিজাত শ্রেণির শক্তিশালী কারো নির্দেশে গৃহীত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রক্ষমতা মূলত: পুঁজিপতি, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ধর্মান্ধ ইসলামী শক্তির মধ্যে বিস্তৃত। এই পুঁজিপতি, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ধর্মান্ধ ইসলামী ভাবাপন্ন দলগুলো দেশের স্থানীয় স্বার্থন্বেষী টাউট শ্রেণির মাধ্যমে সাধারণ জনগণের নির্বাচনী আচরণকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই নির্বাচনী ব্যবস্থায় মূলত: কিছু ক্ষমতাধর পুঁজিপতি পরিবার ক্ষমতায় আসে। এই পূঁজিপতি ক্ষমতাধর শ্রেণিটি স্বাধীনতার পরপর ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে পুঁজিপতি অভিজাত শ্রেণিতে পরিণত হয়। গত কয়েক দশকে এই শ্রেণি তাদের প্রজন্মকে একটি বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষিত করে গড়ে তুলে। এই প্রজন্মটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন একটি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষিত হওয়ার কারণে ধ্যান-ধারণা ও মনোভাবে না বাঙ্গালী না ইংরেজ হিসাবে গড়ে উঠে। বর্তমানকালে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থিত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি যে প্রজন্ম রেখে যাচ্ছে তারা প্রথমে দেশে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত হয়ে, পরবর্তীতে পাশ্চাত্য দেশে পুনরায় ইংরেজি সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ইংরেজি মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। তাদের রেখে যাওয়া প্রজন্মটি ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত হওয়ায় এ প্রজন্মটিকে ইংরেজিকেন্দ্রিক ভাষিক আভিজাত্যের প্রতিভূ বলে শনাক্ত করা যেতে পারে। এ শ্রেণিটি জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু তাদের বংশধারা পাশ্চাত্য দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে সচেষ্ট রয়েছে। তারা তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহ ইংরেজিতে নামকরণ করে থাকে এবং এগুলো পরিচালনায় ইংরেজি ব্যবহার করে ইংরেজ-ইংরেজ আবহে বাস করে থাকে। এ শ্রেণিটি বাংলাদেশে ইংরেজি ভাষার প্রতিভূ হিসাবে বিকশিত হয়ে, দেশের ইংরেজিকরণের সহায়ক রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
[লেখকঃ অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি;
পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]