সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে ভোটগ্রহণ। চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত, কোনোরকম বিরতি ছাড়াই। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে স্থগিত হওয়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন আজ বুধবার। তবে এ নির্বাচন ঘিরে রয়েছে সহিংসতা ও কেন্দ্র দখলসহ নানা শঙ্কা। কারণ নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর থেকে এই সিটির ৪১টি ওয়ার্ডের অর্ধেকেরও বেশি এলাকায় ঘটেছে রক্তক্ষয়ী সংঘাত ও সংঘর্ষ। প্রাণহানিও ঘটেছে দু’জনের। ফলে ভোটগ্রহণের সময় ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন ভোটার ও প্রার্থীরা।
শুধু বিরোধী প্রার্থীই নন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও বিদ্রোহী ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থীরা সহিংসতা ও কেন্দ্র দখলের মতো নানা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এসব বিষয় নিয়ে তারা নির্বাচন কমিশনে বহু অভিযোগও করেছেন। অভিযোগের বিষয়টি স্বীকারও করেছেন চসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান। তিনি বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, কেন্দ্র দখল ও কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা বিষয়ে ৬০টিরও বেশি লিখিত আবেদন ও অভিযোগ জমা পড়েছে। এরমধ্যে ৩৪টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়েছে। আর কেন্দ্র দখল ও পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে পুরো নির্বাচনী এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ভোটারদের আশ্বস্ত করতে চাই- ভোটকেন্দ্রে এসে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন।
সহিংসতা রোধে পুলিশ-বিজিবি মোতায়েন: নির্বাচনে সহিংসতা রোধে সোমবার প্রচারণার শেষদিন মধ্যরাতে চট্টগ্রামে পুলিশ-র্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা টহল শুরু করেন।
এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা হাসানুজ্জামান বলেন, সহিংসতা রোধে ইতিমধ্যে মাঠে পুলিশ-র্যাব-বিজিবি তৎপরতা শুরু করেছে। নির্বাচনী প্রচারণার গত ২১ দিনে সংঘটিত সহিংসতা, প্রার্থীদের অবস্থান, বিগত নির্বাচন পরিস্থিতি বিবেচনায় চসিকের ২০টি ওয়ার্ডকে সংঘাতপূর্ণ ও ৪১৭ ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিএমপি।
ফলে ভোটের নিরাপত্তায় সোমবার দিবাগত মধ্যরাত থেকেই মাঠে নেমেছে নগর পুলিশের ৭ হাজার ২৫৯ সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৯ হাজার সদস্য। এরমধ্যে ২৫ প্লাটুন বিজিবি সদস্য রয়েছে। সংঘাতপূর্ণ ওয়ার্ড ও ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে ভোটের দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন থাকছে।
সিএমপি’র বিশেষ শাখার উপ-কমিশনার মো. আবদুল ওয়ারিশ বলেন, চসিক নির্বাচনে নগর ও হাটহাজারী উপজেলা মিলিয়ে ৭৩৫টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এরমধ্যে ৪১৭টি ভোটকেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে প্রায় ৮ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েনসহ বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। এরমধ্যে অস্ত্রধারীসহ ছয়জন করে পুলিশ সদস্য ও ১২ জন করে আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে। আর এর বাইরে সাধারণ কেন্দ্রে অস্ত্রধারীসহ চারজন পুলিশ ও ১২ জন করে আনসার সদস্য থাকবেন।
এ ছাড়া নগরীর ২০টি ওয়ার্ডকে অত্যন্ত সংঘাতপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- ২ নং জালালাবাদ, ৪ নং চান্দগাঁও, ৭ নং পশ্চিম ষোলশহর, ৮ নং শুলকবহর, ৯ নং উত্তর পাহাড়তলী, ১২ নং সরাইপাড়া, ১৩ নং পাহাড়তলী, ১৪ নং লালখান বাজার, ১৫ নং বাগমনিরাম, ১৬ নং চকবাজার, ১৭ নং পশ্চিম বাকলিয়া, ১৮ নং পূর্ব বাকলিয়া, ১৯ নং দক্ষিণ বাকলিয়া, ২২ নং এনায়েতবাজার, ২৮ নং পাঠানটুলি, ৩০ নং পূর্ব মাদারবাড়ি, ৩৩ নং ফিরিঙ্গিবাজার, ৩৬ নং গোসাইলডাঙ্গা, ৪০ নং উত্তর পতেঙ্গা ও ৪১ নং দক্ষিণ পতেঙ্গা।
ফলে এসব ওয়ার্ডে কেন্দ্রের বাইরে টহল পুলিশ, সাদা পোশাকের পুলিশ ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা তৎপর থাকবে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকবে নগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, কাউন্টার টেরোরিজম ও সোয়াট।
৪১ ওয়ার্ডে থাকছে ৬৯ ম্যাজিস্ট্রেট:
নির্বাচনের সার্বিক শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ৬৯ জন ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের দিন মাঠে সক্রিয় থাকছে। তাদের নির্দেশনায় স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে কাজ করবেন বিজিবি সদস্যরা। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ২৫ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
এমন তথ্য দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিশেষ করে কাউন্সিলর পদ নিয়ে অনেকগুলো ওয়ার্ডেই সংঘাতের আশংকা রয়েছে। ভোটের প্রচারণায় এরই মধ্যে প্রাণ গেছে দুজনের।
সাত ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা: সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সাত ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ২৬শে জানুয়ারি মঙ্গলবার মধ্য রাত থেকে নির্বাচনের পরদিন অর্থাৎ ২৮শে জানুয়ারি পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। মঙ্গলবার বিকালে সিএমপি’র এক বিজ্ঞপ্তিতে এ নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ট্রাক, পিকআপ, বেবিটেক্সি/অটোরিকশা/ইজিবাইক, মাইক্রোবাস, কার ও জীপ এই ৬ ধরনের যানবাহনের পাশাপাশি ২৫শে জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাত থেকে ২৮শে জানুয়ারি সকাল ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, উপরোল্লিখিত নিষেধাজ্ঞা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের (পরিচয়পত্র থাকতে হবে) ক্ষেত্রে শিথিলযোগ্য। তাছাড়া নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত দেশি ও বিদেশি সাংবাদিক (পরিচয়পত্র থাকতে হবে), নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনে বৈধ পরিদর্শক এবং কতিপয় জরুরি কাজ যেমন- এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি কার্যক্রম ব্যবহারের জন্য উল্লিখিত যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে উক্ত নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।
এ ছাড়া জাতীয় মহাসড়ক, বন্দর ও জরুরি পণ্য সরবরাহ সহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এরূপ নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহ মো. আব্দুর রউফ।
কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে ভোটের সরঞ্জাম: মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে নগরীর এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেসিয়াম হল, আগ্রাবাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, নাসিরাবাদ বালক উচ্চ বিদ্যালয়, বন্দর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২টি অস্থায়ীসহ ৭৩৫ কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি বিতরণ শুরু হয়।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের সরঞ্জামাদি কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। সেখানে সরঞ্জামাদিগুলো চেক করে দেখা হবে। সমস্যা হলে তা দ্রুত সমাধান করে আগামীকালের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ২৯শে মার্চ চসিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বিভিন্ন মহল থেকে দাবির প্রেক্ষিতে এই নির্বাচন স্থগিত করা হয় ইসি’র পক্ষ থেকে। পরে ইসি’র নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২৭শে জানুয়ারি বুধবার সকাল ৮টা থেকে চসিক নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হবে।
এতে ৭৩৫ জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ৪ হাজার ৮৮৬ জন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ৯ হাজার ৭৭২ জন পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ জন ও নারী ভোটার ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ জন। ভোটগ্রহণ হবে ইভিএমে।