আজ বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে দেশে করোনার প্রত্যাশিত টিকা প্রয়োগ আজ বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে। গত প্রায় ১১ মাস ধরে এক অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়ছে মানুষ। জীবন-জীবিকার তাগিদে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলেও ভাইরাস মানুষের প্রাণ কাড়ছে প্রতিদিনই। বন্ধ রয়েছে সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত আট হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে করোনা। এমন পরিস্থিতি ভাইরাস জয়ে আজ থেকে শুরু হওয়া ভ্যাকসিন যুদ্ধকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বিকাল সাড়ে ৩টায় ভ্যাকসিন কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভার্চ্যুয়ালি সংযুক্ত হয়ে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন তিনি।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু বেরোনিকা কস্তা প্রথম টিকা গ্রহণ করার কথা রয়েছে। এরপর ২৫ জনকে একে একে করোনা টিকা দেয়া হবে এখানে। পরদিন বৃহস্পতিবার ঢাকার পাঁচটি হাসপাতালে মোট ৬৯০ জনকে ড্রাই রান বা পরীক্ষামূলক এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে।  সারা দেশে ব্যাপকহারে ভ্যাকসিন দেয়া হবে ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে। প্রথম মাসেই ৬০ লাখ মানুষ ভ্যাকসিন পাবেন। তার আগে সবাইকে আজ থেকে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। এজন্য ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ প্রস্তুত রয়েছে। ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরুর সময়েই এই অ্যাপের উদ্বোধন করা হবে।

এদিকে, গতকাল বিকালে কুর্মিটোলা হাসপাতালে টিকাদান স্থান পরিদর্শন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এ সময়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, আগামী ৭ই ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হবে। মন্ত্রী জানান, বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন। এরপর এখানে ২৫ জনকে করোনা টিকা দেয়া হবে। তিনি জানান, প্রথম দিন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা টিকা পাবেন তাদের ৫ জনের টিকা দেয়া দেখবেন প্রধানমন্ত্রী। কুর্মিটোলা ছাড়াও ঢাকায় আরো ৪টি হাসপাতালে পরদিন টিকাদান শুরু হবে।

গত ২৫শে জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রথম মাসেই ৬০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে। তার আগে সবাইকে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। এজন্য ‘সুরক্ষা অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে। নিবন্ধনের পর সেখান থেকেই জানা যাবে, কবে কখন টিকা নিতে হবে। তবে শুধু ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষেরা এই টিকা নিতে এবং নিবন্ধন করতে পারবেন। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্কদের ওপর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি। পরিচয় যাচাইয়ে এই অ্যাপে ১৮টি শ্রেণি করা হয়েছে। যার একটি নির্বাচন করার পর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্ম তারিখ দিয়ে নিবন্ধন শুরু করতে হবে।  যারা নিবন্ধন করে প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজ নিতে ব্যর্থ হবেন তাদের বিষয়ে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আপাতত নেই। অর্র্থাৎ যে কেন্দ্রে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেবেন তাকে সেই কেন্দ্রেই দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। তা না হলে বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন নষ্ট হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, নিবন্ধন অনুযায়ী টিকাকেন্দ্রে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে।

২৫ জন নেবেন প্রথম দিন: প্রথম দিন তিনজন চিকিৎসক, তিনজন নার্স, ১০ জন ভিআইপি নাগরিকসহ মোট ২৫ জনকে করোনা টিকা দেয়া হবে। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক এবং সংগীতজ্ঞও আছেন। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে টিকাদান শুরু হবে। এখানে যে ২৫ জন প্রথম দিন টিকা নেবেন ইতিমধ্যে তাদের তালিকা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন চিকিৎসক, তিনজন নার্স, হাসপাতালে কর্মরত একজন আনসার, একজন আউটসোর্সিং কর্মী নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া ১০ জন বিভিন্ন পেশার খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্য সাত স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন।

করোনা টিকা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মিডিয়া সেল সূত্রে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর ২৮শে জানুয়ারি রাজধানীর চারটি সরকারি হাসপাতালে এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে টিকাদান করা হবে। ইতিমধ্যে এসব হাসপাতালে টিকাদান কেন্দ্র করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের প্রত্যেকটিতে আটটি করে স্টেশন করা হবে। প্রত্যেকটি স্টেশনের জন্য দুজন টিকাদান কর্মী এবং চারজন স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা। ইপিআই স্টোরস বা ক্লোড চেইন থেকে টিকা হাসপাতালগুলোতে পৌঁছে দেবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ। ওই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০০ জনকে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন এবং বাকি তিনটি হাসপাতাল যথাক্রমে কুর্মিটোলা, কুয়েত মৈত্রী এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ জনকে টিকা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এসব হাসপাতাল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পরিদর্শন করেছেন।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় ২৯৪টি টিকাদান কর্মীর দল করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে অর্থাৎ সারা দেশে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনার জন্য আরো ৬ হাজার ৪৩১টি দল করা হয়েছে।  মোট প্রাক্কলিত টিম ৭ হাজার ৩৪৪টি। এসব দলে দুজন কর্মী এবং চারজন স্বেচ্ছাসেবক থাকবেন।

ভ্যাকসিনের লট রিলিজ সনদ দিলো ঔষধ প্রশাসন: গতকাল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে জানান, ভারত থেকে আসা করোনা ভ্যাকসিনের লট রিলিজ সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তিনটি লটে আমাদের পাঁচ লাখ ভায়েল এসেছে। ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এখানে রয়েছে। এই ৫০ লাখ ডোজের লট রিলিজের সার্টিফিকেট আমরা দিয়েছি। এগুলো এখন ব্যবহার করা যাবে। আরো যে ২০ লাখ ডোজ এসেছে, সেটির নথিপত্র জমা হলে আমরা লট রিলিজের সার্টিফিকেট ইস্যু করে দেবো। আমাদের তিন জন এক্সপার্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) স্বীকৃত পদ্ধতিতে ল্যাবরেটরিতে বসে সায়েন্টিফিক যে অ্যানালাইসিস, সেগুলো করছেন। মাহবুবুর রহমান আরো বলেন, বেক্সিমকো যে ভ্যাকসিনগুলো এনেছে, সেগুলো মানবদেহে ব্যবহারের উপযুক্ত। ভারতে যে ন্যাশনাল কন্ট্রোল ল্যাবরেটরি সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (সিআরআই) সমস্ত টেস্ট করা হয়েছে। তার পরে তারা লট রিলিজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন। সেখানে যে বিভিন্ন টেস্টগুলো করা হয়েছে, আমরা সেগুলো মিলিয়ে দেখেছি ঠিক আছে কিনা। সার্বিকভাবে সমস্ত প্যারামিটার আমরা সঠিক পেয়েছি।

ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনা ভ্যাকসিন ‘কোভিশিল্ড’ নামে উৎপাদন করছে। দেশের শীর্ষ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে সেই ভ্যাকসিনেরই ৫ই নভেম্বর তিন কোটি ডোজ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। ২৫শে জানুয়ারি প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ ঢাকায় পৌঁছে। এর আগে ২১শে জানুয়ারি উপহার হিসেবে ভারত থেকে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছে বাংলাদেশ। আর কোভ্যাক্সের ৬ কোটি ৮০ ডোজ টিকা মে-জুন মাসে আসবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, প্রথম ভ্যাকসিন নেয়ার মাঝে দুই মাসের বিরতির পর দ্বিতীয় টিকা দেয়া হবে। এজন্য প্রথম ধাপে আসা ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এবং উপহার পাওয়া ২০ লাখ ডোজ সবমিলিয়ে ৬০ লাখ মানুষকে দেয়ার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রতিদিন ২ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। প্রথম ধাপে ৮০ বছরের বেশি বয়সী আর স্বাস্থ্যকর্মীরা ভ্যাকসিন পাবেন। পরের ধাপে ৭০ বছরের বেশি বয়সীরা পাবেন।

তালিকাভুক্ত জনগোষ্ঠীকে ৮ সপ্তাহ ব্যবধানে (১ম ডোজের ৮ সপ্তাহ পর ২য় ডোজ) ভ্যাকসিন দেয়া হবে। প্রাপ্ত ভ্যাকসিনের মাসভিত্তিক বিতরণ তালিকা দেখা যায়, ফেজ-১; স্টেজ ১ এ; ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী টিকা পাবেন।  অর্থাৎ ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। ভ্যাকসিন কেন্দ্রগুলো হচ্ছে-উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা/ সদর হাসপাতাল, সরকারি, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল, পুলিশ, বিজিবি হাসপাতাল ও সিএমএইচ ও বক্ষব্যাধি হাসপাতাল।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031