ঢাকা : ঋণের কিস্তি তুলতে ভোলেনি তারা।দারিদ্র্যপীড়িত কুড়িগ্রামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওর ছড়াছড়ি। দারিদ্র্য বিমোচনে নানা কর্মসূচি কিংবা গরিব মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সহায়তা ও সাফল্যের বিজ্ঞাপন বছরজুড়ে প্রচার করে এসব সংস্থা। কিন্তু প্রায় এক মাস ধরে বন্যা চলাকালে দুর্গতদের পাশে পাওয়া যায়নি তাদের।
সংস্থাগুলোর স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি তাদের কাছে। তাই তাদের কিছু করার ছিল না।
এ নিয়ে দুর্গত মানুষ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে অসন্তোষ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নানা উদ্যোগ থাকলেও প্রধানত ক্ষুদ্রঋণই তাদের বহুল প্রচলিত কর্মসূচি। এই বন্যার সময়ও এই কর্মসূচি চালু আছে দুর্গত এলাকায়। কেবল ঋণ বিতরণ নয়, কিস্তি আদায়ও চালু আছে প্রায় সব এলাকায়। এই বন্যায় কোনো আয় না থাকলেও দুর্গতরা অন্য জায়গা থেকে ধারদেনা করে কিস্তি পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন।
জেলার রৌমারীর বাসিন্দা রেশমা। স্বামী নেই। বেশ কিছু জমিজমা ছিল তার। কিন্তু এই বন্যা তাকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের ¯্রােত ভাসিয়ে নিয়েছে বাড়িঘর। জমির ফসল সবই গেছে। বলতে গেলে বানভাসা বাড়ি থেকে কিছুই নিয়ে আসতে পারেননি তিনি। কোনো রকমে সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সাইক্লোন শেল্টারে। রেশমা বলেন, ‘সরকারি কিছু ত্রাণ পাইছি। বহু এনজিও থাকলেও এখন কাউকে পাউছি না। কেউ হামার দিকে এখন দেখে না।’
এটা কেবল কুড়িগ্রামের রৌমারীর চিত্র নয়। বন্যাকবলিত ১৬ জেলাতেই কমবেশি এই অবস্থা। দুর্গত এলাকাগুলোর প্রায় সব কটিতেই গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশাসহ বড় এনজিওর পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের ছোট বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম রয়েছে। সেবামূলক নানা কর্মকা-ের প্রচারও আছে এসব সংস্থার। এই বন্যার মধ্যেও সেসব প্রচারের পোস্টার, লিফলেট চোখে পড়ে। কিন্তু মানুষ যখন বাড়িঘর, ফসল হারিয়ে বিপদগ্রস্ত, তখন হাত গুটিয়ে বসে আছে সংস্থাগুলো।
মানিকগঞ্জের শিবালয়, টাঙ্গাইলের কালিহাতী, সিরাজগঞ্জ সদর, বগুড়ার ধুনট, গাইবান্ধা সদর, নীলফামারীর ডিমলা, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় দুর্গত এলাকা ঘুরে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
স্বভাবতই দুর্যোগের মধ্যেও হাত গুটিয়ে বসে থাকা নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন এনজিওগুলোর স্থানীয় কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বন্যার্তদের ত্রাণ দিতে কেন্দ্রীয় কোনো নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত না আসায় কিছু করেননি তারা।
গত ৩১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং এনজিওগুলোকে বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানান। তবে শুক্রবার পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ের কোনো বেসরকারি সংস্থা বা সংগঠনের ত্রাণ পায়নি দুর্গতরা।
জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগসচিব শাহ কামাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা সরকারিভাবে প্রায় সব বন্যাকবলিত জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর আমি মনে করি সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায় থেকে বন্যার্তদের জন্য কাজ করা উচিত। এটা সবার মানবিক দায়িত্ব।’
শনিবার কুড়িগ্রামে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নির্লিপ্ততায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এই অবস্থাতেও বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না এনজিওগুলো। কেউ কেউ এগিয়ে এলেও তাদের মধ্যে আন্তরিকতা নেই।’
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সহসভাপতি এ এফ মুজতাহিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এনজিওরা ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে- এ ধরনের কোনো খবর আমরা জাতীয় গণমাধ্যমে দেখি না। তার মানে তারা কোনো সাহায্য করে না। অথচ তারা সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বলেই দেশি-বিদেশি ফান্ড আনে। হাজার হাজার এনজিও আসলে কী করছে, তার খোঁজ-খবর সরকারের নেয়া উচিৎ।’
‘টাঙ্গাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের সাহায্য দেয়ার রীতি নেই’
আমাদের জেলা প্রতিনিধি রেজাউল করিম জানান, জেলার ভূঞাপুর, নাগরপুর, দেলদুয়ার, গোপালপুর, ধনবাড়ী ও মির্জাপুর উপজেলায় লাখো মানুষ এবার বন্যাকবলিত। এসব উপজেলার সবগুলোতেই ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা করে প্রতিষ্ঠিত সব এনজিও। করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নানা কর্মকা- করার দাবি করেছেন সবগুলো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই। তাহলে কেন বন্যাদুর্গতদের পাশে নেই আপনারা- জানতে চাইলে ভুয়াপুর উপজেলার গ্রামীণ ব্যাংকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক আব্দুল খালেক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে ত্রাণ বিতরণের কোনো নির্দেশনা আসেনি। এ কারণে আমরা কোনো পদক্ষেপই নেইনি।’
আশা, বুরো বাংলাদেশ, সেতুসহ বিভিন্ন এনজিওর শাখা ব্যবস্থাপকরাও একই ধরনের কথা বলেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের টাঙ্গাইল সদরের সুরুজ শাখার ব্যবস্থাপক মাসুদ পারভেজ জানান, ‘আমাদের এই অঞ্চলে ব্র্যাকের ত্রাণ সহায়তা দেয়ার কোনো রীতি নেই।’
নাগরপুর এলাকার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানিক পরোয়ান বলেন, ‘আমরা সরকারি ত্রাণ পেয়েছি, তাও একবার। কোনো বেসরকারি সংস্থার সহায়তা পাইনি।’
গোপালপুরের বাসিন্দা মালেকা বেগম জানান, সরকরি-বেসকারি কোনো পর্যায় থেকেই তারা কোনো সাহায্য পাননি।
লালমনিরহাটে তালিকা তৈরি করছে একটি এনজিও
আমাদের জেলা প্রতিনিধি এস কে শাহেদ জানান, এই জেলাতেও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ত্রাণ তৎপরতা চোখে পড়েনি। তবে আরডিআরএস-এর জেলা ব্যবস্থাপক মাহবুব আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা তালিকা তৈরি করছি। এখনো ত্রাণ বিতরণ করিনি।’
গ্রামীণ ব্যাংকের আঞ্চলিক সহকারী ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘প্রতিবছরই আমরা ত্রাণ দেই, তবে এবার এখনো দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি।’
বেসরকারি সংস্থা আশাও ত্রাণ দেয়নি। এই সংস্থাটির স্থানীয় শাখার কর্মকর্তা সোহেলের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করেও তাকেও পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে ব্র্যাকের জেলা অফিসের ব্যবস্থাপক আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ৯৬ হাজার টাকা ত্রাণ সহায়তা বিতরণ করেছি। সামনে এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
সিরাজগঞ্জে ‘শেষ বেলায়’ প্রস্তুতি চলছে
আমাদের জেলা প্রতিনিধি রানা আহমেদ জানান, এই জেলায় যমুনার তীরের জনপদ থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। যখন পানিতে ভাসছিল মানুষ তখন এই জেলার এনজিওগুলো হাত গুটিয়ে বসে ছিল। এখনো এই জেলায় বেসরকারি সংস্থাগুলো ত্রাণ তৎপরতায় এখনো অংশ নেয়নি। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন কথা বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি জাতীয় সংস্থা আশার সিরাজগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক বলেন, ‘প্রতি বছর বর্নাত্যদের আমরা ত্রাণ বিতরণ করে থাকি। আমরা এবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকা তৈরি করছি, ত্রাণ বরাদ্দ পেলেই বিতরণ করব।’
ত্রাণ বিতরণে প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকসহ বেশকিছু এনজিওর কর্মকর্তারাও।
বরাদ্দ নেই, তাই তৎপরতা নেই গাইবান্ধায়
আমাদের জেলা প্রতিনিধি উত্তম সরকার জানান, এই জেলাতেও জাতীয় পর্যায়ের কোনো এনজিও দুর্গতদের ত্রাণ সহায়তা দেয়নি।
জানতে চাইলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার জেলা ব্যবস্থাপক বলেন, ‘আমাদের কাছে ত্রাণ দেয়ার মতো কোনো বরাদ্দ নেই। ওপর থেকে বরাদ্দ না দিলে তো আমরা দিতে পারি না।’ একই কথা বলেছে ব্র্যাক ও গ্রামীণ ব্যাংকের স্থানীয় শাখার ব্যবস্থাপকরা।
এবার হাত গুটিয়ে নীলফামারীর এনজিওগুলোও
আমাদের জেলা প্রতিনিধি এস কে প্রিন্স জানান, প্রতি বছর বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে নানা সংস্থা। তবে এবার নীরব সবগুলো সংস্থাই।
ডিমলা উপজেলার বাসিন্দা হাসান আলী বলেন, ‘আগে আমাদের বিভিন্ন সংস্থা সহায়তা দিত। কিন্তু এ বছর কেউ আসেনি।’
চলতি বছর কেন এমনটি হলো এ বিষয়ে জানতে পপি, আশা, ল্যামসহ বিভিন্ন সংস্থার স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি।