থামছেই না চাল নিয়ে চালবাজি । মিলারদের কারসাজিতে ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে বাজার। ইতিমধ্যেই গরিবের ৩০-৩২ টাকা দরের চাল রেকর্ড ভেঙে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় উঠেছে। আর সরু চাল উঠেছে সর্বোচ্চ ৭০ টাকা পর্যন্ত। এমন অস্বাভাবিক দামে চিড়েচ্যাপ্টা সাধারণ ক্রেতারা। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া মানুষদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এমনিতেই করোনাকালে মানুষের আয় কমেছে। এ অবস্থায় চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের চড়া দামে অসহায় হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
অন্যদিকে সরকার এবার ধান-চাল সংগ্রহে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ধানের দাম বাড়তির অজুহাতে চালের দাম সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৪-৫ টাকা বেশি চেয়েছেন মিলাররা। তবে মন্ত্রণালয় থেকে মিলারদের দাবি নাকচ করে দিয়ে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আমদানির জন্য দরপত্রও আহ্বান করে মন্ত্রণালয়। এতে সরকারের সংগ্রহ কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। যদিও দাম নিয়ে আপত্তি থাকা সত্ত্বেও কয়েকটি অঞ্চলের মিলাররা সরকারকে চাল দিয়েছেন। তবে চালের দাম না কমায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সর্বমহলে।
এরই প্রেক্ষাপটে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুল্ক কমিয়ে নতুন করে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতদিন চাল আমদানিতে ৬২.৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হলেও এখন তা দিতে হবে ২৫ শতাংশ। শুল্কহার কমছে ৩৭.৫ শতাংশ। অর্থাৎ আগের চেয়ে অর্ধেকের চেয়েও বেশি কমানো হয়েছে। নতুন শুল্কহারে চাল আমদানি করতে আগামী ১০ই জানুয়ারির মধ্যে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে পারবেন আমদানিকারকেরা। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে আগে থেকেই বলা হয়েছে, দেশে চালের কোনো ঘাটতি নেই। মূলত কারসাজি করে চালের সংকট সৃষ্টি করে দাম বৃদ্ধি করছেন মিলাররা। তাই মিলারদের সিন্ডিকেট না ভেঙে শুধু আমদানি করলেই চালের দাম তেমন কমবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
গতকাল সরজমিন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাজারে এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের চাল। ব্যবসায়ীরা জানান, এখন পর্যন্ত আমদানির শুল্কহার কমানোর প্রভাব বাজারে পড়েনি। আমদানি শুরু হলে বাজারে কেমন প্রভাব পড়বে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ দেশে চালের কোনো সংকট নেই। বরং মিলাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। তাই প্রচুর পরিমাণে আমদানি করা হলেও যদি মিলারদের সিন্ডিকেট ভাঙা না যায়, তবে আমদানির শুল্কহার কমানোর প্রভাব বাজারে খুব একটা পড়বে না বলে মনে করেন চালের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। তবে আমদানির দরের ওপর ভিত্তি করেও দেশের বাজারে চালের দাম কিছুটা কমতে পারে। ভারত যদি তুলনামূলকভাবে কম দামে চাল দেয় তবে দেশেও দাম কমার সম্ভাবনা আছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
কাওরান বাজারের জনতা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. আবু ওসমান মানবজমিনকে বলেন, কয়েকদিন ধরে বাজার আরো চড়া। মোটা চালের দাম এখন আগের চিকন চালের দরে চলে আসছে। আমদানি করা না হলে দাম আরো বাড়বে। সুতরাং আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়াটা ভালো হয়েছে। কারণ সরকারের কাছে এর বিকল্প ছিল না। তবে মিলারদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে সেটি আগে ভাঙা দরকার। মিলাররা আমাদের বলেন চালের সংকট। কিন্তু সরকারি হিসেবে দেশে চালের ঘাটতি নেই। তার মানে মিলারদের কারসাজি আছে। তিনি বলেন, মিলারদের কাছে আমরা অসহায়। তারা যদি আমাদের ১ কেজি চাল দিয়ে বলে আর দেবো না। তাহলে আমাদের এখানে কিছুই করার নেই। তারা বাজার চালায়। তারা যেভাবে বলবে সেভাবে বাজার চলবে। তাই আপাতত আমদানি করলে হয়তো দামে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলে বাজারে কখনোই শৃঙ্খলা আসবে না। তবুও আমদানি করা হলে ভারতের দর অনুযায়ী আমদানিকারকরা দাম ঠিক করবেন। সেই হিসেবে ভারতের দর তুলনামূলকভাবে কম হলে আমাদের দেশেও কমবে।
গত রোববার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানান, বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চালের দাম নিয়ে ভোক্তাদের যাতে কষ্ট না হয়, আবার কৃষকও যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সেজন্য নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় চাল আমদানির সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমদানির মাত্রা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে? এর ব্যাখ্যায় মন্ত্রী বলেন, কেবল বৈধ আমদানিকারকরা মন্ত্রণালয়ে আমদানির আবেদন করতে পারবেন। সেখান থেকে মন্ত্রণালয় কাকে কী পরিমাণ আমদানি করতে দেবে সেই সিদ্ধান্ত জানাবে। অনুমোদন পাওয়ার পর কে কী পরিমাণ আমদানি করেছে সেই হিসাবও রাখা হবে। দাম না বাড়ালে মিলারদের চাল না দেয়ার হুমকি প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার কারও হুমকিতে মাথা নত করে না। মিলারদের চুক্তির জন্য পীড়াপীড়ি করিনি আমরা। তারা তাদের হুমকি নিয়ে থাকুক। প্রয়োজনে আমরা কৃষকের কাছ থেকে ধান বেশি করে কিনবো। দরকার হলে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল কিনবো। ওদিকে সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে দেড় লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করে সরকার। ভারতীয় চালের দাম পড়বে প্রতি কেজি ৩৩-৩৫ টাকা। সর্বমোট ৪ লাখ টন চাল সরকারিভাবে আমদানির দরপত্র সচল হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী।
কাওরান বাজারের চাল ব্যবসায়ীরা জানান, খুচরা বাজারে এখন মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা কেজি। মাঝারি চাল, বিআর-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৮ টাকা কেজি। আর সরু মিনিকেট ও নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬২-৭০ টাকা কেজি দরে।
মোহাম্মদপুরের একজন ভোক্তা কাজী আনোয়ার হোসেন বলেন, যে চাল কিছুদিন আগে ৩৫ টাকা কেজি করে কিনেছি, তা এখন ৫০ টাকার উপরে। ৭০ টাকা কেজি দরে চাল কিনে খেতে হবে কখনো ভাবিনি। আমরা যারা স্বল্প আয়ের মানুষ তারা কীভাবে বাজার করে খাবো। এমনিতেই বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম চড়া। তেল, পিয়াজ, আলুসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে। সবজির দাম কিছুটা কমেছে কিন্তু আবারো বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখনো কিছু সবজির দাম চড়া। তিনি বলেন, ধনীদের জন্য হয়তো কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে তো সবাই ধনী না। বেশির ভাগ মানুষদের কষ্ট করে খেটে খেতে হয় এবং তাদের আয়-রোজগারও খুব একটা বেশি না। যা আয় হয় তার বেশি অংশ বাসা ভাড়া আর খাবার খরচে চলে যায়। বরং সংসার চালাতে তাদের এমনিতেই হিমশিম খেতে হয়। তার ওপর করোনাকালে আয়-রোজগার আরো কমে গেছে। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্যের চড়া দামে মানুষ আজ অসহায় হয়ে পড়েছে।