সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম দামে ‘দামি’ ফোন মিলবে এমন একটি চটকদার বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়ে। সিফাত পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ১৫০ টাকা দিয়ে অনলাইনে সেই ফোনের অর্ডার করেন। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার চুক্তি হয় বাকি ৭ হাজার ৫০০ টাকা এসএ পরিবহন থেকে পার্সেল গ্রহণ করে দেয়ার জন্য। নির্ধারিত একটি তারিখে সিফাত টাকা দিয়ে এসএ পরিবহনের একটি শাখা থেকে মোবাইলের একটি বক্স নিয়ে আসেন। বাসায় এসে সিফাত বক্সটি খুলে দেখেন ভেতরে ভাঙাচোরা কম দামের একটি মোবাইল ফোন। সঙ্গে সঙ্গে সিফাত মোবাইল বিক্রেতা ওই সাইটের এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন। তারা সিফাতকে জানায়, ভুল করে ওই পণ্যটি পাঠানো হয়েছে।
তবে আরো ২ হাজার টাকা দিলে অর্ডার করা পণ্যটি পাঠানো হবে। উপায়ন্তর না পেয়ে সিফাত আবার দুই হাজার টাকা তাদেরকে পাঠান। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আর কোনো মোবাইল পাঠায়নি। অনেকবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাভ হয়নি।
করোনাকালে ঘরবন্দি মানুষকে টার্গেট করে এমন ভয়ঙ্কর অনলাইন প্রতারণা করছে কয়েকটি চক্র। অনলাইনে বিভিন্ন পণ্যর চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে তারা নিম্ন্নমানের পণ্য পাঠিয়ে আবার অনেক সময় প্রকৃত পণ্য না দিয়ে আলু/পটল/পিয়াজের মতো পণ্য পাঠিয়ে প্রতারণা করছে। আর গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অনলাইন সাইটে পণ্যের অর্ডার করে প্রতারণার শিকার এখন হাজার হাজার মানুষ। এসব ভুক্তভোগী অভিযোগ দেয়ার মতো জায়গাও খুঁজে পাচ্ছেন না। বড়জোর থানায় একটি জিডি করে রাখছেন। অথচ প্রতারণা করে চক্রের সদস্যরা লাখ লাখ টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। বড় ধরনের প্রতারণা করেও তারা অনেক সময় আইনের আওতায় আসছে না।
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের নামে সাইট খুলে ভয়ঙ্কর অনলাইন প্রতারণা চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগ। তারা হলেন, রকি বিশ্বাস (২৫), মো. হেকমত আলী (২৭), মো. কচিবুর রহমান (২২), শিমুল মণ্ডল (২৭), মো. আনিছুর রহমান শেখ (২৯) ও মো. মাজহারুল ইসলাম (২৪)। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত এসএ পরিবহন পার্সেল অ্যান্ড কোচ সার্ভিসের বুকিং মেমো ২০২টি, পণ্য বিক্রয়ের ক্যাশ মেমো ১১৭টি, ৪৬ জোড়া বিভিন্ন রঙের ব্যবহারের অযোগ্য জুতা, ১০টি চার্জার, ১টি ল্যাপটপ, ১৫টি বিভিন্ন পণ্যের বুকিং ফেরতযোগ্য বক্স, ১২টি বিভিন্ন মডেলের ব্যবহারের অযোগ্য মোবাইল ফোন ও ব্যবহারযোগ্য ১৪টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এই চক্রটি তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে সর্বমোট ২৪টি সাইট খুলে মানুষের সঙ্গে অনলাইন প্রতারণা করছে। এসব সাইটের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডও রয়েছে। ডিবি জানিয়েছে, দারাজ অনলাইন, দারাজ অনলাইন৭১, দারাজ অনলাইন শপ, দারাজ এক্সপ্রেস, দারাজ অনলাইন বিডি, ফ্যাশন জোন, গ্যালাক্সি২৪, অনলাইন মোবাইল গ্যালাক্সি, শপিং সেন্টার নেট, শপিং জোন বিডি, শপিং ডেলস, স্মার্ট শপ বিডি, উইনটার কালেকশন, সোনিয়া ফ্যাশন হাউজ, সু বাজার ডটকম, ফ্যাশন হাউজ২৪, চায়না ফ্যাশন বিডি, বিডি ফ্যাশন শপসহ আরো অনেক নামে-বেনামে পেজ খুলে তারা প্রতারণা করতো।
ডিবি জানিয়েছে, চক্রের সদস্য কচিবুর রহমান ৫টি পেজ, রকি বিশ্বাস ও হেকমত ১৬টি পেজ ও শিমুল মণ্ডল ৩টি পেজ পরিচালনা করতো। এসব পেজে তারা সবসময় ভালোমানের মোবাইল, জুতা, ঘড়ি, থ্রি-পিস, শাড়িসহ মূল্যবান প্রয়োজনীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতো। কোনো ব্যক্তি এসব পণ্য দেখে অর্ডার করলে ১৫০ টাকা নিয়ে অর্ডার কনফার্ম হওয়ার পর চক্রের সদস্যরা ঢাকার বিভিন্ন ফুটপাথ থেকে কম দামে পণ্য কিনে প্যাকেট করে ক্রেতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতো।
ডিবি জানায়, প্রতারক চক্রের কাছ থেকে কেউ যদি এস এ পরিবহন থেকে কন্ডিশনে টাকা দিয়ে পণ্য বুঝে নিতে রাজি হতো তাহলে প্রথমে তারা ১৫০ টাকা বিকাশের মাধ্যমে নিতো। বাকি টাকা এস এ পরিবহন নিয়ে পরে তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়। কেউ যদি হোম ডেলিভারির মাধ্যমে পণ্য চায় সেক্ষেত্রে পার্সেলের ১৫০ টাকাসহ পণ্যের মূল্য অনুযায়ী সমুদয় টাকা বিকাশের মাধ্যমে নেয়। অনেক সময় তারা টাকা পেয়ে কোনো পণ্য না পাঠিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ক্রেতারা যদি অন্য কোনোভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তবে প্রতারকরা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।
ডিবি জানিয়েছে, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে শত শত মানুষকে প্রতারিত করে এভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অভিযানের সময় তাদের বাসা থেকে ২০২টি এস এ পরিবহনের বুকিং ভাউচার ও ১১৭টি পণ্য বিক্রির রশিদ পাওয়া গেছে। তবে ঠিক কতো মানুষের সঙ্গে তারা এভাবে প্রতারণা করে কতো টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তার কোনো হিসাব ডিবি দিতে পারেনি। তবে ডিবি জানিয়েছে, শুধু এই চক্রটি নয়, সম্প্রতি অনেক প্রতারকই অনলাইনে ভুয়া সাইট খুলে মানুষকে ঠকাচ্ছে। এসব প্রতারকের বিরুদ্ধে ডিবির অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এদিকে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়ার কারণে মোবাইল ফোনের প্রয়োজন হয়। তাই মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীকে টার্গেট করে প্রতারক চক্রের সদস্যরা কম দামে দামি ফোন দিবে এমন চটকদার বিজ্ঞাপন ফেসবুকে দেয়। তারা যে পেজগুলো অপেন করে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নামের মতোই। পণ্যের অর্ডার পাওয়ার পর প্রতারকরা দামি ফোনের টাকা নিয়ে ভাঙাচোরা, নষ্ট বা কম দামি মোবাইল ক্রেতাদের দেয়। তাদের কাছ থেকে ৩১৯টি বুকিং মেমো ও পণ্য বিক্রির রশিদ এবং ২৪টি পণ্য বিক্রির সাইট পাওয়া যায়। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য তারা এস এ পরিবহনের মতো কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পণ্য পাঠায়।
এই প্রতারণার বিষয়ে ডিবি কীভাবে জানতে পেরেছে সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতারণার শিকার হয়ে এক ভুক্তভোগী থানায় জিডি করেছিল। ওই জিডির সূত্র ধরে ডিবি তদন্তে নেমে চক্রটির সন্ধান পায়। দারাজের মতো প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে তারা এই প্রতারণা করছে। যখন উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যরা প্রতারণার শিকার হয় তখন হয়তো তারা কিছু মনে করে না। কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের মানুষ যখন প্রতারণার শিকার হলে সেটি খুবই দুঃখজনক। কারণ সন্তানেরা অনলাইনে ক্লাস করার জন্য অভিভাবকরা কষ্টের টাকা থেকে মোবাইল কিনে দেন। আর প্রতারকরা কম দামের ফোন দিয়ে বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাই জনগণ যাতে প্রতারিত না হয় এবং পণ্যর কোয়ালিটি নিশ্চিতের জন্য আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করবো। এস এ পরিবহন টাকা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি দেয়। এ ছাড়া তারা পণ্য রিসিভের সময় স্ক্রিনিং বা চেক না করে পণ্য নিচ্ছে তাই এসব প্রতারণায় প্রতিষ্ঠানটির কোনো দায় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসকে দায় দিবো না। কারণ তারা শুধু পরিবহন করে। স্ক্রিনিং বা পণ্য চেকের বিষয়ে বলেন, তারা মোবাইলের অর্ডারে মোবাইল, জুতার অর্ডারে জুতা দিচ্ছে। ভেতরে কি আছে সেটি হয়তো তারা দেখছে না।