মাদক ভয়ঙ্করভাবে ছড়াচ্ছে। অলিগলি থেকে শুরু করে সর্বত্র। বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব থেকে শুরু করে মরণনেশা মাদকের কারবার হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানেও। এমনকি স্কুল-কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানের আড়ালেও হচ্ছে মাদক বাণিজ্য। মাদকের মূলহোতারা সমাজের প্রভাবশালী। রাজধানীতে মাদকের এ রকম অর্ধশত মূলহোতা রয়েছে । তাদের বিপুল সংখ্যক কর্মী-সহযোগী রয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, পরিচালনা পরিষদের সদস্য, এমনকি মাদকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের দায়িত্বেও রয়েছেন তারা।
কখনো কখনো সুবিধাবঞ্চিতদের মধ্যে বস্ত্র ও ত্রাণও বিতরণ করেন তারা। স্থানীয়ভাবে দাতা হিসেবে পরিচিত এই মাদক কারবারিরা থাকেন ধরা ছোঁয়ার আড়ালে। তাদের অধীনস্থরা বিভিন্ন এলাকায় মাদক বিক্রি করেন। আটক হন। কিন্তু মূলহোতারা আড়ালেই থেকে যান। এরমধ্যে কয়েক জনের নামে মামলা হলেও তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
তাদের মধ্যে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ইশতিয়াক ওরফে কামরুল হাসান দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। মোহাম্মদপুর, বসিলা, দারুসসালাম, মিরপুর ও রূপনগর এলাকায় রয়েছে তাদের মাদকের কারবার। তার লোকজন টেকনাফ থেকে ইয়াবা সংগ্রহ করে এসব এলাকায় বিক্রি করে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু ব্যক্তিদের সহযোগিতায় মাদক কারবার করে ইশতিয়াক। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই আত্মগোপনে যায় সে। ইশতিয়াক আত্মগোপনে থাকলেও মাদক কারবারের অভিযোগ, মামলার আসামি হয়েও অনেকে বীরদর্পে রাজত্ব করছেন এলাকায়। বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তাদের একজন গোলাম মোস্তফা শিমুল। সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় মাদক বাণিজ্যের হোতা শিমুলের বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদ করতে গিয়েছেন তারাই হুমকি-ধমকি ও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। দীর্ঘদিন থেকেই মাদকের বাণিজ্য করে আসছে শিমুল। এই তালিকায় আরো রয়েছে, বংশালের নাছির উদ্দিন, বাড্ডার রিয়াদউল্লাহ, উত্তরার ফজলুল করিম, ভাটারার ছাব্বির হোসেন, আনোয়ারা, আসমা আহম্মেদ ডালিয়া ও রবিউল ইসলাম দম্পতি, ওয়ারির কামাল হোসেন, যাত্রাবাড়ীর মোবারক হোসেন বাবু, কলাবাগানের শামীম আহমেদ, শামসুর রহমান, ফারজানা ইসলাম স্বপ্না, গেণ্ডারিয়ার রহিমা বেগম, মুগদার পারভীন, উত্তর মাণ্ডার শফিকুল ইসলাম, দক্ষিণ মাণ্ডার আলম, ডেমরার রাজু আহমেদ, মতিঝিলের লিটন, কামরাঙ্গীরচরের খুরশিদা ওরফে খুশি, চকবাজারের দুই ভাই ওমর ফারুক, সুমন, লাল মিয়া, কলাবাগানের নাজমুস সাকিব, মিরপুর-১১ এর ইমতিয়াজ। তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন পরিচয়ের আড়ালে মাদক বাণিজ্য করে যাচ্ছে। অভিযান হলে তাদের মাঠ পর্যায়ের সহযোগীরা গ্রেপ্তার হয়। তবে গত বছরের অক্টোবরে মাদক বাণিজ্যের হোতা তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তারপরই আলোচনায় আসে তার মাদকবাণিজ্য।
খিলগাঁও এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নাচ, গান করেন সুবর্ণা রূপা। স্বামী, সন্তান সঙ্গে না থাকলেও বিভিন্ন পরিচয়ে থাকেন কয়েক তরুণ ও এক তরুণী। শিল্পী হিসেবে পরিচিত তিনি। এই পরিচয়ের আড়ালে তার মাদক বাণিজ্য। কক্সবাজারের মেয়ে সুবর্ণা রূপা ঢাকায় ইয়াবার ডিলার। গত বছরের অক্টোবরে বিপুল ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো তাকে।
রমনা, সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বিভিন্ন সময়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র্যাব অভিযান চালিয়ে নাহিদ, হাসান, বাবুল, সাগরসহ অনেক তরুণ মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু তাদের মাদকের ডিলার বা মূলহোতা থেকে গেছে আড়ালেই। অবশ্য পূর্বে র্যাবের অভিযানে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয় শিমুলকে। অতীতে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, শিমুল, শিশির চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী। তারা দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদকের ব্যবসা করে আসছে। সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কক্ষ দখল করে রাতে মাদক ব্যবসা পরিচালনা, বিদ্যালয়ের মাঠে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিং করে চাঁদা উত্তোলন, মাঠে টর্চারসেল স্থাপন, বিদ্যালয়ের জায়গায় দোকান করে তারা ভাড়া তুলছে। এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় আগ্নেয়াস্ত্রসহ ওই বিদ্যালয়ে ঢুকে তিন শিক্ষককে মারধর করে তারা। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নিরাপত্তাকর্মীরা অভিযোগ করেন, শিমুল, শিশিররা বিদ্যালয়ের পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করে থাকে। রাতে বিদ্যালয়ের ফটক খুলে রাখতে বাধ্য করে।
এই চক্রের শিশির এখন সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান। স্কুল কমিটির পদের আড়ালে রয়েছে তার মাদক বাণিজ্য। কিশোর গ্যাংসহ একটি চক্রকে দিয়ে মাদক বাণিজ্য করায় শিশির। প্রায়ই এই চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ওই এলাকার সাবেক কাউন্সিলর মুন্সী কামরুজ্জামান কাজল বলেন, শিমুল চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী। কিন্তু প্রভাবশালীদের নাম ভাঙ্গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আড়ালে অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাদকের গডফাদার থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ীদেরও তালিকা রয়েছে। সে অনুসারে অভিযান হচ্ছে। এরমধ্যে রাজধানীতে মাদকের অন্তত অর্ধশত বড় কারবারি রয়েছে। তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা সুব্রত সরকার শুভ বলেন, সামাজিক পরিচয়ে আড়ালে যারা মাদক বাণিজ্যে জড়িত তাদের বিষয়ে যথাযথ তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। তাদের ধরার জন্য আমরা ছক পেতে থাকি, সুযোগ পেলেই আইনের আওতায় আনা হয়। জনপ্রতিনিধিসহ কাউকে ছাড়া দেয়া হবে না বলে জানান তিনি।
মোহাম্মদপুরের ইশতিয়াক দীর্ঘদিন থেকে পলাতক। সর্বশেষ দেশে প্রকাশ্যে থাকাকালে দান-খয়রাত ও মাদকবিরোধী মিছিল-মিটিংয়ে সক্রিয় ছিলো। কিন্তু আড়ালে চলতো মাদকের কারবার। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, কয়েক মাস আগে তার অবস্থান ছিল মালয়েশিয়ায়। বর্তমানে কোথায় আছে সেই তথ্য নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। মোহাম্মদপুরে মাদকবিরোধী সভা-সেমিনার করলেও মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে গোলাম জিলানী, মোল্লা আরশাদ, শাকিল, মাছুয়া সাঈদ, মিরপুরের ইকবাল, নুর ইসলাম, মিরপুরের মিস্টার। মোস্তাক আহমেদ। তিনি মাদকবিরোধী আন্দোলনের নেতা। মিরপুর বিহারী ক্যাম্পে মাদকবিরোধী সভা-সমাবেশ করেন নিয়মিত। গত অক্টোবরেও পল্লবীর বড় মসজিদের সামনে মাদকবিরোধী সমাবেশ করেন তিনি। এসব সমাবেশে উপস্থিত থাকেন পুলিশের কর্মকর্তারাও। কিন্তু তার দুই ছেলের নিয়ন্ত্রণেই মিরপুরের ক্যাম্পগুলোর মাদক বাণিজ্য। তার ছেলে ইমতিয়াজ নিয়ন্ত্রণ করতেন পল্লবীর এমসিসি ক্যাম্পের ইয়াবার স্পট। মাদক বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে গত ২৭শে জুলাই মাদক নিয়ে বিরোধ হলে এক তেল ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ইমতিয়াজ ও তার বন্ধু রনিকে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মূলহোতা ইমতিয়াজ কারাগারে থাকলেও থেমে নেই তাদের মাদক বাণিজ্য। মাদকবিরোধী সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে মাদক বাণিজ্য করে যাচ্ছে রাজধানীর এই চক্রগুলো। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা নানা পরিচয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হতে এই বাণিজ্যে জড়াচ্ছে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে রক্ষা পেতে ধর্মীয় পরিচয় ও দলীয় পদ থেকে শুরু করে নানা পরিচয় ব্যবহার করে। মাদক বাণিজ্যে জড়িতদের আইনের আওতায় নিতে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ কোনো মাদকই দেশে তৈরি হয় না। তাই উৎস মুখগুলো বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।