ঢাকা : বাংলাদেশকে লাল তালিকাভুক্ত করেছে দুর্নীতি, ঋণপ্রাপ্তির জটিলতাসহ ৯ সূচকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মিলেনিয়াম কর্পোরেশন (এমসিসি)। এ কারণে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডের (এমসিএফ) প্রায় ৫০ কোটি ডলারের অনুদান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এই বিশাল অংকের অনুদান পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। কিন্তু নির্ধারিত সূচকে অগ্রগতি না হওয়ায় এ অর্থ পাওয়া যাচ্ছে না।
এমসিসির সর্বশেষ মূল্যায়নে (অর্থবছর ২০১৬) উঠে এসেছে এ চিত্র। প্রতিবছর মূল্যায়ন করে সংস্থাটি। দীর্ঘ কয়েক বছর চেষ্টা করেও সূচকে উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। কর্মকর্তারা বলছেন এ সংক্রান্ত ফাইলগুলো নিয়ে বর্তমানে কোনো কাজ করা হচ্ছে না। কারণ কোনো লাভ নেই।
সূত্র জানায়, এমসিএফ-এ যুক্ত হতে ২০টি সূচকে অগ্রগতি অর্জন করে যোগ্য প্রমাণ করতে হয় যে কোনো দেশকে। অর্থবছর ২০১৬-এর মূল্যায়নে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ৯টি সূচকে রেড বা লাল তালিকায় রয়েছে। বাকি ১১টি ক্ষেত্রে গ্রিন বা সবুজ তালিকায়। রেড তালিকায় থাকা সূচকগুলো হচ্ছে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্বনীতি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার মান, বাণিজ্য নীতিমালা, জমির অধিকার ও প্রাপ্যতা, ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ব্যয় এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা। অর্থবছর ২০১৫তেও একই অবস্থান ছিল বাংলাদেশের। অন্যদিকে গ্রিন তালিকায় থাকা সূচকগুলো হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতিতে নারী-পুরুষের সমতা, ব্যবসা শুরু, টিকা দেয়ার হার, মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার হার, শিশু স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক অধিকার, বেসামরিক লোকের স্বাধীনতা, তথ্যের স্বাধীনতা, সরকারের কার্যকারিতা এবং আইনের ভূমিকা।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মঙ্গলবার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা এ ফান্ডের অর্থ থেকে বঞ্চিত, এটা দুর্ভাগ্য ও হতাশাব্যঞ্জক। এই ফান্ডের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে সেটি বিতর্কের বিষয়। কিন্তু তারা যে সূচকগুলো নির্ধারণ করেছে সেগুলো যৌক্তিক। বাংলাদেশে দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে। এটা বাস্তবতা। তাই সরকারের উচিত অস্বীকার না করে দুর্নীতিকে মোকাবেলা করা। এক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশকে আজ রেড তালিকায় থাকতে হতো না।
ঋণপ্রাপ্তিসহ অর্থনৈতিক বিষয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট লাল তালিকায় রাখে তাদের স্বার্থে। কেননা দুর্নীতি থাকলেও বাংলাদেশে ঋণপ্রাপ্তিতে কোনো বাধা নেই। দুর্নীতি তাদের দেশেও আছে। তাই বলে আমি দুর্নীতিকে সমর্থন করছি না। এটাকে দমন করতে হবে। সেজন্য রেড তালিকায় রাখার বিষয়টি ঠিক নয়। বাংলাদেশের ফিসক্যাল পলিসি স্বাভাবিক রয়েছে। বাণিজ্য পলিসিও খারাপ নয়।
এ প্রসঙ্গে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি কোনো সংস্থা বাংলাদেশকে রেড তালিকায় রাখল না রাখল এতে কিছু যায় আসে না। কিছু অর্থ সহায়তা না পেলেও চলবে। কয়েকদিন আগে মস্কোতে আমি যে চুক্তি (রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য) করে এলাম, এতে আমাদের অনেক লাভ হবে। তবে দুর্নীতির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
এ প্রসঙ্গে ইআরডির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরে বিরাজ করছে। দিন দিন তা না কমে বরং বাড়ছে। এছাড়া এমসিসি যে সূচকগুলো দিয়েছে সেগুলোর দ্রুত উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাই এ ফাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় নষ্ট করা ছাড়া কিছু নয়। আমরা এখন এই ফান্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে কোনো প্রচেষ্টাই চালাচ্ছি না।
এ সূচকগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইআরডির সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতির মধ্যে সুশাসনকে ধরা হয় সবার আগে। এটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে। কিন্তু সেক্ষেত্রেই কোনো উন্নতি নেই। নিয়ন্ত্রক মানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যেসব নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বিটিআরসিসহ সরকারের রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর কাজের মান সন্তোষজনক নয়। জমি অধিকার ও প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, জমি সংক্রান্ত মামলাগুলো কোর্টে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকে, নিষ্পত্তি হয় না। ব্যাংক ঋণ পেতে কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয়। তাছাড়া সুদের হার এখনও ১৩-১৪ শতাংশ। বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে ২-৩ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেখানে জিডিপির ৪-৫ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে এখনও ১ শতাংশের নিচে। প্রাথমিক শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের সামান্য উপরে। দেশের নদীগুলো দখল-দূষণে মরে যাচ্ছে। মৎস্য সম্পদ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বন ধ্বংস করা হচ্ছে। এসব নানা কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় লাল তালিকায় রাখা হয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার বিষয়টি রেড তালিকায় থাকা প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে নদী-খালসহ দখলদারিত্বের সংস্কৃতি চলছে। নেতানেত্রীরাই বলছেন নদী রক্ষা করা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকার অসহায়। তাছাড়া রামপাল ইস্যু এখন ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। কারণ অনেকেরই ধারণা এটি ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজ সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে। তাই আমাদের নিজেদের স্বার্থেই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় তৎপর হতে হবে।
সূত্র জানায়, প্রথমদিকে ১৭টি নির্দেশক থাকলেও সর্বশেষ ২০১২ সালে ৮টি নতুন নির্দেশকসহ মোট ২০টি নির্দেশক যুক্ত করা হয়। ওই বছরই সর্বশেষ মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ডে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সে সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরের সময় ওই ফান্ডে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তাকে অনুরোধ জানানো হয়। এ প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন সরকারের প্রতিনিধি তখনকার ইআরডি অতিরিক্ত সচিব আরাস্তু খান। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিবছর বাংলাদেশের পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এর মধ্যে এমসিএফ’র বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে টেকনিক্যাল টিম পাঠাতে বলেছিল। কিন্তু টেকনিক্যাল টিম পাঠানো হলেও চ্যালেঞ্জ ফান্ডে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আর এগোয়নি।
ইআরডি সূত্র জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড গঠন করে এবং এটি পরিচালনার জন্য ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন বা এমসিসি। ফান্ড গঠনের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। এমসিএফ’র আওতায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচিত দেশগুলোকে সহায়তা করে থাকে। এর একটি হচ্ছে থ্রেসহোল্ড কান্ট্রি বা কম অংকের সহায়তার দেশ। এই প্রোগ্রামের আওতায় সাধারণত ১০ কোটি থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত অনুদান প্রদান করা হয়ে থাকে। অন্যটি হচ্ছে কমপ্যাক্ট অর্থাৎ বড় অংকের সহায়তা। এর আওতায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার থেকে বিভিন্ন অংকের অনুদান দেয়া হয়ে থাকে। এই ফান্ডের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যুক্ত করতে প্রতিবছর বৈঠক করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি)।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৬, শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চ্যালেঞ্জসমূহ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির সূচকে অবস্থার কিছুটা উন্নতি সত্ত্বেও দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নে একটি বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) দুর্নীতির ধারণা সূচকে পৃথিবীর ১৬৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৯তম। আফগানিস্তানকে বাদ দিলে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে নিচে। বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ সার্ভেতে দেখা যায় ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিকে তাদের ব্যবসার জন্য একটি প্রধান সীমাবদ্ধতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও বলেছেন দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর জিডিপির শতকরা ২-৩ শতাংশ ক্ষতি হয়।