মা-ছেলের মধ্যে প্রায়ই বিভিন্ন বিষয়ে ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকতো। সৎ মা সীমা আক্তার (৩১)-এর সঙ্গে বনিবনা ছিল না আশিকুর রহমান নাহিদের (২৭)। বিশেষ করে সৎ মা যখন নাহিদের প্রকৃত মাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন সেটি মেনে নিতে পারতো না নাহিদ। এ ছাড়া পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে তার বাবা শাহজাহান সিকদার (৫০)-এর সঙ্গে কথাকাটাকাটি হয়। নাহিদের ধারণা ছিল তার বাবা পারিবারিক সম্পত্তি সৎ মাকে লিখে দেবেন। নাহিদ সৎ মায়ের সঙ্গে থাকতে অনিচ্ছাও পোষণ করেছিল। তার দাবি ছিল তার সম্পত্তি আলাদা করে দেয়ার জন্য।
কিন্তু তার বাবা সেটি মেনে না নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন বলে হুমকি দেন নাহিদকে। এ ধরনের নানা ক্ষোভ থেকেই পরিকল্পিতভাবে সৎ মা সীমা আক্তারকে রোববার কুপিয়ে হত্যা করে নাহিদ। হত্যার ঘটনা আড়াল করার জন্য সে তার সৎ মায়ের মরদেহে আগুন লাগিয়ে নাটক সাজায়। কিন্তু রেহাই পায়নি। পুলিশ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় নাহিদকে গ্রেপ্তার করেছে। সে ছাড়া এ ঘটনায় সন্দেহভাজন সীমা আক্তারের ভাই হেলাল শরীফের করা মামলায় আরো পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাহিদ সৎ মাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে গতকাল আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।
ডিএমপি’র মিরপুর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. কামাল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, নাহিদ একাই তার সৎ মাকে হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মিলেছে। এই হত্যাকা-ের পেছনে চরম ক্ষোভ ও সম্পত্তির লোভ ছিল। নাহিদের মায়ের মৃত্যুর বছরখানেকের মাথায় তার বাবা সীমা আক্তারকে বিয়ে করেন। নাহিদের আর কোনো ভাইবোন ছিল না। তাই মায়ের প্রতি ভালোলাগা ছিল অন্যরকম। কিন্তু সীমা নাহিদের মৃত মাকে নিয়ে প্রায়ই বাজে কথা বলতেন। তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানকে বৌভাতের অনুষ্ঠান বলেও সীমার আত্মীয়স্বজনরা মন্তব্য করেছিলেন। কথায় কথায় সীমা নাহিদের মাকে নিয়ে এমন সব কথা বলতেন যেটি কিছুতেই মানতে পারতো না। এসব নিয়ে তার ভেতরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তার স্ত্রী আইরিন সন্তান সম্ভবা ছিলেন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নাহিদ এক/দেড় মাস আগে বাবার কাছে সম্পত্তির ভাগ চায়। সে তার ভাগের টাকা দিয়ে ব্যবসা করবে বলে জানিয়েছিল। তার বাবা অপারগতা দেখিয়ে তাকে রাস্তায় ফেলে দেবে বলে জানান। এসব বিষয়ে নাহিদ খুবই হতাশ ছিল।
সীমার স্বজনরা জানিয়েছেন, ৮ বছর আগে প্রথম স্বামী ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে সীমার ছাড়াছাড়ি হয়। প্রথম সংসারে তার হোসাইন আহমেদ (১৫) ও মাহিয়া (৭) নামের দুই ছেলে ও মেয়ে আছে। মেয়েটি গ্রামে দাদা-দাদীর কাছে ও ছেলেটি মিরপুরে থাকে। সীমা ঢাকায় একটি হাসপাতালের ফার্মেসিতে কাজ করতেন। এসময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় শাহজাহান সিকদার নামের এক ব্যবসায়ীর। ১০ মাস আগে শাহজাহান ও সীমা বিয়ে করেন। সীমার মতো শাহজাহানের এটি ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। শাহজাহানের আগের সংসারেও নাহিদ সিকদার নামে একটি ছেলে রয়েছে। নাহিদ তার স্ত্রী আইরিনকে নিয়ে মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের ইমামনগর পূর্ব বাইশটেকি ৫৫/৬/সি নম্বর ৭তলা বাসায় থাকতো।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নাহিদের সঙ্গে তার সৎ মায়ের সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। তবে কিছুদিন আগে নাহিদ শ্বশুরবাড়ি থেকে আসার পর ঝামেলার সৃষ্টি হয়। সে তার সৎ মায়ের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে ঝগড়াঝাঁটি করতো আর বলাবলি করতো একসঙ্গে থাকবে না। স্ত্রী আইরিনকে নিয়ে আলাদা থাকবে। ওই রাতে এসব ঝামেলা নিয়ে নাহিদের শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্ত্রী নাহিদের বাবা ও মা সীমাসহ সবাই বসে একটি মীমাংসার বৈঠক করছিল। পারিবারিক ওই বৈঠকে নাহিদ দাবি করে তার হাত খরচের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে। পারিবারিক মীমাংসা সভায় সেদিন তার বাবা তাকে আলাদা হয়ে যেতে মানা করেন এবং একসঙ্গে থাকলে মাসে ২০ হাজার টাকা দিতে রাজি হন। কিন্তু নাহিদ সেটি মানেনি। সে ভেবেছিল তার বাবার ২টি ফ্ল্যাট, কার্টনের ব্যবসা ছাড়া অন্যান্য টাকা তার বাবা সৎ মায়ের নামে লিখে দেবেন। এসব নিয়েই সীমার সঙ্গে নাহিদ খারাপ ব্যবহার করতো।
সীমার প্রথম সংসারের ছেলে হোসাইন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, সে মিরপুর-১ নম্বরে থেকে একটি ওয়াশ ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। রোববার দুপুরে তাকে খবর দেয়া হয় তার দাদা মারা গেছেন। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ পায়। ওই সময় তার মায়ের মরদেহ আর দেখতে পারেনি। গতকাল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে মায়ের মরদেহ দেখেছে। হোসাইন আহমেদ আরো জানায়, কয়েকদিন আগেই তার মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। শীতের জামাকাপড় বা টাকা লাগবে কিনা এসব বিষয়েই মায়ের সঙ্গে কথা হয় তার। এটিই ছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ কথা।
রোববার বেলা ১১টার দিকে কাফরুল থানার পূর্ব বাইশটেক এলাকার একটি বাসা থেকে সীমা আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে প্রথমে উপর্যুপরি ছুরি দিয়ে হত্যা করে মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনায় কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন সীমার ভাই হেলাল শরীফ। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সীমার সৎ ছেলে আশিকুর রহমান নাহিদ ছাড়া অন্যরা হলেন, জাকিয়া সুলতানা আইরিন (২২), আসেক উল্লাহ (৫০), রোকেয়া বেগম (৪০), শাহজাহান শিকদার (৫০) ও সাকিব (২০)। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রত্যেকে এজাহারনামীয় অভিযুক্ত।
ওদিকে সীমা আক্তারের মরদেহের ময়নাতদন্ত গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে সম্পন্ন হয়েছে। ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা তার ময়নাতদন্ত করেন। পরে মরদেহ সীমার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ মোকসেদপুর উপজেলার ডাংগা দুর্গাপুর গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তার মরদেহ দাফন করা হয়েছে।