নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে চাকরির আবেদন করেন তাওহিদ রবিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘লাইভ গার্ড সিকিউরিটি সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের । রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার এ বাসিন্দার সঙ্গে পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন ওই প্রতিষ্ঠানের একজন সহকারী ম্যানেজার। তিনি ইন্টারভিউর সময় ও ঠিকানা মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে পাঠান রবিনকে।
ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে এক প্রাথমিক ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হন রবিন। তাকে জানানো হয়, মূল ইন্টারভিউর জন্য ৫০০ টাকা দিয়ে একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। ৫০০ টাকা দেওয়ার পর তাকে কিছু প্রশ্নসহ একটি উত্তরপত্র দেওয়া হয়। এটি পূরণ করার পর চাকরি নিশ্চিত করতে চাওয়া হয় আরও ৪ হাজার ২০০ টাকা। এই টাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুস্ট করার খরচ হিসেবে নেওয়া হচ্ছে বলে তাকে জানান ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যরা। এতে রাজি না হয়ে আগে দেওয়া ৫০০ টাকা ফেরত নিয়ে চলে আসেন তিনি।
সঙ্গে আলাপকালে তাওহিদ রবিন বলেন, ‘ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখলাম। বেতন কাঠামো ভালো। তাই আমি কাস্টমার কেয়ার অফিসার পদে আবেদন করি। ইন্টারভিউর জন্য সেখানে গিয়ে দেখি, এটা যে কোনো অফিস তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। নেই কোনো সাইনবোর্ড। কিন্তু অফিসের ভেতরে গিয়ে দেখি, চাকরিপ্রত্যাশীদের ভিড়।’
ইন্টারভিউর জন্য অপেক্ষা করার সময় রবিনের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর। তাদের সবারই চাকরির খুব প্রয়োজন। রবিন বলেন, `ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া বেশির ভাগ মানুষই আমার মতো টাকা না দিয়ে ফিরে এসেছে। আবার কেউ কেউ ওই টাকা দিয়ে জয়েন করেছে।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, সহকারী ম্যানেজার পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে বিএ। এ পদে বেতন উল্লেখ করা হয়েছে ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। কাস্টমার কেয়ার অফিসার পদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক। বেতন ১৭ হাজার ৫০০ টাকা।
রাজধানীর মিরপুরের সেকশন-১২ এর বি-ব্লকের, ৪ নম্বর সড়কের ৬৩ নম্বর ভবনে চাকরির এমন ব্যবসা পেতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি। যাদের নিয়োগপত্র দেওয়া হচ্ছে, সেখানে রয়েছে মিরপুরের সেকশন-৬ এর এ-ব্লকের ৫/৪৩ নম্বর বাড়ির ঠিকানা।
তাদের বেতন কাঠামো দেখে একই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন হুমায়রা সিদ্দিকা। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে তিনিও রবিনের মতো সেখান থেকে ফিরে আসেন।
হুমায়রা বলেন, ‘ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে আমি আবেদন করেছিলাম। সেখান থেকে আমার সঙ্গে একজন যোগাযোগ করে। অফিসের ঠিকানা পাঠায়। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি, পদে পদে টাকা চাচ্ছে। এখানে যে চাকরির নামে প্রতারণা হচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে আমি চলে আসি।’
রবিন এবং হুমায়রা পরিস্থিতি বুঝে পিছপা হলেও অনেকেই এ ফাঁদে আটকে যান। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, ‘লাইভ গার্ড প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’ মূলত কোনো চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান নয়। প্রতিষ্ঠানটিতে কোনো কাজ নেই। এখানে কাজ হলো- নিদিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে একজন ‘চাকরি’ নিয়ে আরও একাধিক জনকে চাকরিতে নিয়ে আসবেন, তাদের মাধ্যমে আরও আরও ব্যক্তি চাকরি নেবেন একই পদ্ধতিতে। এটা অনেকটা মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) মতো প্রতারণা।
গত সেপ্টেম্বরে প্রতারক প্রতিষ্ঠানটির ফাঁদে পড়েন এক ব্যক্তি। সহকারী ম্যানেজার পদের জন্য ৮ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে চাকরি নেন তিনি। মানি রিসিটে লেখা রয়েছে এই টাকা ফেরতযোগ্য। প্রতিষ্ঠানটিতে নিজের কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, তিনি টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়ার পর তার মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। সে বিজ্ঞাপন দেখে যারা আগ্রহী হয়, তাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন। তাদের ডাকা হয় ইন্টারভিউর জন্য। চাকরিতে জয়েন করতে চাওয়া হয় টাকা। যারা টাকা দিয়ে জয়েন করেন, একইভাবে তাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে আবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তারাও আবার নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের চাকরি দেন। এভাবে একে অন্যের চাকরি দিয়ে চলে তারা। ভাগাভাগি হয় কমিশন। চাকরি দেওয়াটাই এখানে চাকরি বলে জানান ওই ভুক্তভোগী।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘করোনাকালে চাকরি ছিল না। চাকরির খুব দরকার ছিল। আমি খুব গরিব মানুষ। তখন টাকা ধার করে ৮ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে এখানে জয়েন করি। যখন ট্রেনিং রুমে গেলাম তখন পুরো বিষয়টা বুঝলাম। তারা বলল, আমি যেভাবে জয়েন করেছি একইভাবে আমাকে ২৫ জন লোককে চাকরিতে আনতে হবে। এখানে আমি আপনাকে ঢুকালাম। আপনি আবার একজকে ঢুকালেন। সে আবার একজনকে ঢুকাল। পুরোটাই প্রতারণা।’
প্রতারণার ফাঁদে পড়ে টাকা দিয়েছেন তিনি। সে টাকা তুলতে গত দুই মাসে তিনজনকে জয়েন করিয়েছেন তিনি। বলেন, `তাদের প্রত্যেকেই আমার পরিচিতজন। একজন আমার ভাইয়ের ছেলে। দুজন আমার বন্ধু। তারা এখন আর আমার সঙ্গে কথা বলে না। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে।’
ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে যারা টাকা গ্রহণ করছেন তারাই প্রতারক চক্রের মূল বলে দাবি করেন তিনি। বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে কথা বলি। ঠিকানা পাঠাই, অফিসে আসতে বলি। কিন্তু আমাদের হাতে টাকা কেউ দেয় না। টাকা নেয় অফিসের ম্যানেজার তুষার, মৌসুমী, ইসরাত, এমডি ইমরান, তার স্ত্রী রিমা।’
প্রতিষ্ঠানটির কাজের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ইন্টারভিউতে কিছু সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন আসে। অনেকেই প্রশ্নগুলোর উত্তর পারে না। কিন্তু ইন্টারভিউতে এসে কেউ বাদ যায় না। উত্তর সঠিক হোক আর ভুল হোক, চাকরি সবার হবে। কিন্তু অনেকে টাকার কথা শুনে চলে যায়। আমার মতো যারা অসহায়, তারা আশায় বুখ বেঁধে জয়েন করে। কিন্তু কিছুদিন পর যখন দেখে বেতন নাই, তখন হা-হুতাশ করে চলে যায়।’
বিজ্ঞাপন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমাদের ফোন নম্বর নিয়ে তারাই বিজ্ঞাপন দেয়। লাইভ গার্ড সিকিউরিটি, লাইভ গার্ড প্রাইভেট লিমিটেড নামে তাদের সাত-আটটা পেইজ আছে। সেখানে বিজ্ঞাপনগুলো দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপন দেওয়ার সময় আমি দেখেছি, তাদের বিজ্ঞাপনের ওপর বিডি জবস-এর লোগো লাগানো হয়, যেন বিষয়টা সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।’
একটি অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা অনলাইনে আবেদন করে, তাদের সিভির কপি আমাদের পাঠানো হয়। আবেদনকারীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ করতে দেয়। আমরা ফোন করি। তাদের সঙ্গে কথা বলি। টাকার কথা বলার পর অনেকে আসে না। কিন্তু যাদের চাকরি খুবই দরকার তারা প্রতারিত হয়।’
প্রতিষ্ঠানটিতে এ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতরা চাকরিপ্রত্যাশীদের থেকে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে দাবি এ ভুক্তভোগীর। তিনি বলেন, ‘এখানে যারা ম্যানেজার আছে, তাদের একেকজনের আন্ডারে অনেক লোক জয়েন করছে। সবার কাছ থেকেই টাকা নিচ্ছে। সব আমাদের মতো মানুষের কষ্টের টাকা।’
‘লাইভ গার্ড সিকিউরিটি সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের’ ম্যানেজার মৌসুমি জানান, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরানুল ইসলাম। তবে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সৌরভ হোসেন। আর চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন তাসলিমা সুলতানা।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ইমরানুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি দাবি করেন, তাদের কার্যক্রম বৈধ। তিনি বলেন, ‘আমার এখানে চাকরির ক্ষেত্রে আমরা অনলাইনে অ্যাড (বিজ্ঞাপন) দেই। পোস্টারিং করি। যারা আমাদের এখানে কাজ করে পোস্টারে-বিজ্ঞাপনে তাদের নম্বরগুলো দেই। যারা গার্ড হিসেবে আসতে চায় তারা আমার স্টাফদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা যে কয়টা গার্ড নিয়ে আসে, আমি তাদের এর একটা পার্সেন্টেজ দেই।’
চাকরি দেওয়ার নামে বিজ্ঞাপন দিয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ টাকা নেওয়ার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আপাতত অফ (বন্ধ) আছে। জয়েন করতে হলে সাড়ে চার হাজার টাকা, পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। আমরা যে বিজ্ঞাপনগুলো দেই, সেটার খরচটা আমরা নেই। ট্রেনিং খরচ নেই। কারো কাছ থেকে জোর করে টাকা নেওয়া হয় না।’
এই কার্যক্রম বৈধ কি-না এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি তিনি। বলেন, ‘আমার কোম্পানিটা এখন বন্ধ আছে।’
চাকরি প্রলোভন দেওয়া এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে চাকরিপ্রত্যাশীদের সচেতন থাকতে পরামর্শ র্যাবের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসুর। তিনি বলেন, ‘যারা চাকরিতে আসতে চায়, তারা যেন একটু খোঁজ-খবর নেন আসলে ওই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে কি না। প্রতারক চক্রগুলো খুব স্মার্টলি নিজেদের উপস্থাপন করবে। এখন প্রায় সবার হাতে স্মার্ট ফোন আছে। চাকরিপ্রত্যাশীরা একটু গুগলে সার্চ করতে পারেন তার ওই কোম্পানি সম্পর্কে।’
এ ধরনের প্রতারক চক্র ধরতে ভুক্তভোগীদের অভিযোগের পাশাপাশি র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ কাজ করছে বলে জানান পলাশ কুমার বসু। বলেন, ‘যখনই এ ধরনের প্রতারণা খবর আসছে, ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দেয় বা আমাদের গোয়েন্দা তথ্য পাওয়া যায়, তার ওপর ভিত্তি করে প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নেওয়া এমন একটি বড় চক্র তৈরি হয়ে গেছে। আমরা নজর রাখছি। অভিযান চলমান আছে।’