দেশে এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) পরিচালনা করা অবৈধ। তবুও নানা কৌশলে একশ্রেণির লোক দিনের পর দিন এমএলএমের নামে অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে আসছে। এর মাধ্যমে মানুষকে বোকা বানিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অংকের টাকা।
মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গজিয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতরা ধরাও পড়ছেন। তবুও এদের তৎপরতা থেমে নেই। সবশেষ সোমবার ঢাকায় অবৈধ এমএলএম ব্যবসা করে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তথ্য বলছে, কৌশল বদলে মূলত ই-কমার্সের নামে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করছে। কোনো কোনো কোম্পানি ফুড সাপ্লিমেন্ট, প্রসাধন সামগ্রী ও হারবাল ওষুধ বিপণনের নামেও অবৈধ এমএলএম কার্যক্রম চালাচ্ছে। যদিও ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আছে। কেউ কেউ আবার ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী বিক্রির মাধ্যমেও হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আর অধিক মুনাফার লাভে সহজ-সরল মানুষ বিশেষ করে তরুণরা এসবের সঙ্গে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।
আগস্ট মাস থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত শুধু রাজধানীতেই এমন ই-কমার্সের নামে অনলাইনে এমএলএম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত একাধিক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। র্যাব-সিআইডি ও গোয়েন্দা পুলিশের এসব অভিযানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মূল হোতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক শেখ মো. রেজাহউল হায়দার বলেন, বেআইনি কাজ করতে তো পারমিশন লাগে না। আগে ডেসটিনিরি মতো যারা ছিলো তারা ঘোষণা দিয়ে এসব করতো। কিন্তু এখন কোনো কিছু প্রকাশ না করে ভিন্ন নামে এই ধরণের প্রতারণা করে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। এরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি বিধিবিধানের বাহিরে গিয়ে তারা এগুলো করেন।
গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এমএলএমের বিরুদ্ধে অভিযানের ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গ্রাহকের বিপুল অংকের টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১৩ আগস্ট মধ্যবাড্ডার ট্রপিকাল মোল্লা টাওয়ারের ‘গ্লোবাল গেইন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড’ নামে একটি এমএলএম কোম্পানিতে অভিযান চালায় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে কোম্পানিটির এমডি, সিও, ম্যানেজারসহ মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু জানান, আইনগত সুযোগ না থাকলেও গ্লোবাল গেইন অন্তত ১০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা ডিপোজিট করায়। কোনো কোনো গ্রাহকের কাছে থেকে এক লাখ থেকে শুরু করে তিন-চার লাখ টাকাও হাতিয়ে নিয়েছে। এর ভেতরে এক পরিবারের কাছ থেকে ৫৬ লাখ টাকা নিয়েছে কোম্পানিটি। ওই পরিবারের লোকজন আমাদের অভিযান চালানো হয়। অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়।
এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিলে ‘এ-ওয়ান বাজার লিমিটেড’নামে একটি এমএলএম কোম্পানির সন্ধান পায় র্যাব। মতিঝিলের ১ নম্বর আর কে মিশনের ইত্তেফাক ভবনের পঞ্চম তলায় অভিযানের নেতৃত্ব দেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু।
অভিযানের বিষয়ে তিনি জানান, ‘প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার মাধ্যমে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে তারা ঢাকায় বেশ কয়েকটি অফিস করে ৩০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা বড় ধরনের প্রতারক প্রতিষ্ঠান।’ প্রতিষ্ঠানটি থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
একই মাসের ২৭ তারিখ এমএলএম ব্যবসার নামে প্রতারণা করে ছয় কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এসপিএল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের তিন জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি।
সিআইডি কর্মকর্তারা জানান, গত আট মাসে সোপান প্রডাক্ট লিমিটেড (এসপিএল) প্রতিষ্ঠানের তিন প্রতারক বিনিয়োগের ২৫ শতাংশ বেশি মূলধন দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে এক হাজার ৪২৭ জন মানুষের কাছ থেকে ছয় কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেয় এ চক্রটি।
এসপিএলের কার্যক্রমের বিষয়ে জানা যায়, একজন সদস্য বিনিয়োগের জন্য তিনজনকে নিয়ে এলে তাকে ১০ শতাংশ বোনাসসহ ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত লাভ দেয়া হতো। এভাবে তিন মাসে এক হাজার ৪২৭ জনের কাছ থেকে প্রায় ছয় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্রের সদস্যরা।
সিআইডি কর্মকর্তা মো. রেজাহউল হায়দার এই প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কথা তুলে ধরে বলেন, নাম দেখে বোঝার উপায় ছিল না এটা এমএলএম কোম্পানি। কিন্তু অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করতে গিয়ে ধরা পড়ে। এরা অনলাইনে ই-ব্যাংকিং, ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড দিয়ে দেয়। অনলাইনে টাকা কত জমা হচ্ছে এসব দেখে গ্রাহকরা বেশি আগ্রহ দেখায়। এটা আসলে প্রতারণা। এদের ১৫ থেকে ২০ তম পর্বে গিয়ে যে গ্রাহক থাকেন তিনি প্রতারিত হন। তার কাছ থেকে নেওয়া টাকাগুলো এরা সরাতে থাকে। তখন মানুষের হুঁশ আসে। তাদের উচিত শুরুতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা।
এদিকে রাজধানীতে সবশেষ অনলাইনে ই-কর্মাসের ব্যবসার আড়ালে এমএলএম ব্যবসা চালানো ‘এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের’ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিএমপির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেপ্তার করে। এই প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের বিষয়ে জানা যায়, পিরামিড পদ্ধতিতে সদস্য ও টাকা সংগ্রহ করতো প্রতিষ্ঠানটি। তাদের এই ব্যবসার পুরোটাই অনলাইনভিত্তিক প্রতারণা।
প্রতিষ্ঠানটি ১০ মাসে মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে ২২ লাখ ২৪ হাজার ৬৬৮টি সদস্যদের আইডি থেকে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।
পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা ই-কমার্সের লাইসেন্স দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বোঝাত তারা ই-কমার্স করছে। তারা অ্যালোভেরা শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, চাল, ডাল, মরিচের গুঁড়া শুধুমাত্র তাদের রেজিস্টার্ড সদস্যদের কাছে বিক্রি করত। এর লভ্যাংশ থেকে প্রতি আইডি হোল্ডারকে কোম্পানির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখার বিনিময়ে ১০ টাকা করে দেয়ার কথা বলত।