ভারতীয় কোম্পানি ইএমসি বহুল আলোচিত রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের বিদ্যুৎ সরবরাহের সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ শেষ না করেই বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়েছে । ব্যাংকে জমা থাকা পারফরম্যান্স গ্যারান্টির টাকাও তুলে নিয়েছে তারা। এ কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ দুই বছরের বেশি সময় পিছিয়ে গেছে।
এদিকে মজুরির বকেয়া টাকা না পেয়ে স্থানীয় শ্রমিকরা বটিয়াঘাটা কচুবুনিয়ার রিভার ক্রসিং টাওয়ারের চলমান কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।
দেশ ছেড়ে যাওয়া ভারতীয় ওই কোম্পানির কাছ থেকে ঠিকা নিয়ে বাংলাদেশের যে ঠিকাদাররা কাজ করছিলেন, তারাও পথে বসেছেন। দেশীয় ছোট ছোট ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা পাওনা ওই কোম্পানির কাছে।
এখন প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করে তা বুঝিয়ে দিতে হবে পালিয়ে যাওয়া ভারতীয় কোম্পানি ইএমসির জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি চীনা প্রতিষ্ঠান টিবিইএকে। বকেয়া পাওনার জন্য এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদাররা। টিবিইএ মাত্র ১ কোটি টাকা দিতে রাজি, যা ঠিকাদাররা প্রত্যাখ্যান করেন।
আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে স্থানীয় শত শত শ্রমিক ও সরবরাহকারী প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে অবস্থান কর্মসূচি ও মানববন্ধন করেন। বকেয়া টাকা না পেলে তারা এ প্রকল্পের কাজ করতে দেবেন না বলে মানববন্ধনে জানান বক্তারা।
দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রথম মেগা প্রকল্প রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) ও প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার যে কয়টি সরবরাহ লাইন নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছে, তার মধ্যে একটি খুলনা-মোংলা ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট ট্রান্সমিশন লাইন। ভারতীয় কোম্পানি ইএমসি ও চীনা কোম্পানি টিবিইএর যৌথ উদ্যোগকে (জেভি) এই কাজের জন্য নির্বাচন করে পিজিসিবি। এ জন্য ইএমসি-টিবিইএর সঙ্গে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং বিদেশি মুদ্রায় ৮৫ লাখ ১৬ হাজার মার্কিন ডলারের চুক্তি করে পিজিসিবি। চুক্তির আওতায় সঞ্চালন লাইনটির মালপত্র সরবরাহ, প্রয়োজনীয় খনন ও পরীক্ষণ এবং বাস্তবায়নের কাজ করার কথা ইএমসি ও টিবিইএর।
সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পিজিসিবি ও ইএমসি-টিবিইএর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী পরবর্তী ১৮ মাস, অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুনে সঞ্চালন লাইনটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা। কেন্দ্র থেকে খুলনার হরিণটানা সাবস্টেশন পর্যন্ত লাইনটির দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। দুই দফা সময়সীমা বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শেষ না করে ওই বছরের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় নির্মাণকাজের নেতৃত্বে থাকা ইএমসি। পিজিসিবিকে না জানিয়ে ইএমসি তাদের ঢাকা ও খুলনা অফিস বন্ধ করে দেয় এবং তাদের সব কর্মকর্তা ও প্রতিনিধি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান। ফলে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির কাজ।
১৮ মাসের কাজ দুই দফা সময় বাড়িয়ে ৩৬ মাস পর্যন্ত টেনে নেয় ইএমসি-টিবিইএ। এই যৌথ উদ্যোগের নেতৃত্ব দেয় ইএমসি। কাজ এগোচ্ছিল না বলে কয়েক দফা তাদের তাগাদা দেয় পিজিসিবি। কিন্তু কাজ কাক্সিক্ষত গতিতে সম্পন্ন হয়নি। নিজেদের পাওনা পিজিসিবির কাছ থেকে বুঝে নিলেও স্থানীয় সরবরাহকারী-ঠিকাদারদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়নি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি।
এমনকি প্রকল্প শুরুর দিকে পারফরম্যান্স গ্যারান্টি এবং ইএআর ইনসিওরেন্স হিসেবে ব্যাংকে জমা দেওয়া চুক্তিমূল্যের ১০ শতাংশ (৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং ৮ লাখ ৫১ হাজার মার্কিন ডলার) টাকাও তুলে নিয়ে গেছে ইএমসি।
এমন প্রেক্ষাপটে ইএমসির সাড়া না পেয়ে ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর তাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি চীনা প্রতিষ্ঠান টিবিইএকে চিঠি দেয় পিজিসিবি।
চিঠিতে পিজিসিবি বলে, প্রকল্পের পারফরম্যান্স গ্যারান্টি (পিজি) এবং ইএআর (ইরেকশন অল রিস্কস) ইনসিওরেন্সের মেয়াদ যথাক্রমে গত ২৬ আগস্ট ও ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়েছে। এই পিজি ও ইএআর ইনসিওরেন্সের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য ইএমসিকে দুবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইএমসি তাতে সাড়া দেয়নি। প্রকল্প এলাকায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না। পুরো কাজের ৭৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২৫ শতাংশ বাকি। ওই সময় পর্যন্ত ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছে এবং এ-সংক্রান্ত সব পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এটি পরিষ্কার যে ইএমসি লিমিটেড ইন্ডিয়া প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ইএমসির জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি হিসেবে টিবিইএর দায়িত্ব বাকি কাজ সম্পন্ন করে তা সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়া।
পিজিসিবির ওই চিঠির পর কেটে যায় প্রায় এক বছর। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের আরও দুটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পায় টিবিইএ। খুলনা-মোংলা ২৩০ কেভি ডাবল সার্কিট ট্রান্সমিশন লাইনের বাকি কাজ শেষ না করলে টিবিইএকে কালো তালিকাভুক্ত করা এবং দেশের অন্য কাজগুলোও বাতিলের বার্তা দেয় পিজিসিবি। ওই বার্তার পর ইএমসির বাকি কাজ করে দিতে রাজি হয় টিবিইএ।
২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে টিবিইএ প্রকল্পের অসম্পন্ন কাজ শুরু করে। এ জন্য নতুন করে ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তিও করে। কিন্তু আগের দেশীয় ঠিকাদারদের পাওনা এখনো মেটায়নি। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ভারতীয় যে কোম্পানির (ইএমসি) কারণে এই বিলম্ব হলো তার বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
দেশীয় ঠিকাদাররা তাদের আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে অবগত করেও কোনো সুরাহা পাননি। আর্থিক ক্ষতির শিকার একজন ঠিকাদার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এখন শয্যাশায়ী। অপর প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদাররাও ধারদেনার কারণে অসহনীয় যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছেন। এ নিয়ে তারা পালিয়ে যাওয়া ভারতীয় কোম্পানি ইএমসির জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান টিবিইএর কাছে ধরনা দেন। দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাওনা প্রায় সাড়ে ১১ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র কোটি দিতে প্রস্তাব করেছে টিবিইএ। তাদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ক্ষতিগ্রস্ত দেশীয় ঠিকাদাররা।
২০১৯ সালের মধ্যে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা ছিল। সর্বশেষ প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ উৎপাদন শুরু করবে দেশের প্রথম তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি।