নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। তাই চলছে অভিযান। ইলিশ মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে নদ-নদীতে সব ধরনের মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ। গত ১৪ অক্টোবর থেকে পরবর্তী ২২ দিনের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
এর ফলে রাজশাহীর জেলেরা পদ্মায় মাছ ধরতে নামতে পারছেন না। কিন্তু তারা অভিযোগ করছেন, ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশি জলসীমা থেকে ইলিশ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম যে শুধু এবারই প্রথম তা নয়। বাংলাদেশে মৎস্য শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে প্রতিবছরই ভারতীয়রা ইলিশ ধরে নিয়ে যায়।
বাংলাদেশে নদ-নদীতে মৎস্য শিকার বন্ধ থাকায় সরকার জেলেদের খাদ্য সহায়তা হিসেবে মাথাপিছু ২০ কেজি করে চাল দিচ্ছে। কিন্তু শতভাগ জেলে এই চাল পাচ্ছেন না। ফলে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে এসব জেলেরা বলছেন, নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা ভারতীয়দের মাছ ধরে নিয়ে যাওয়া দেখছেন। কিন্তু তাদের ঘরে খাবার নেই। মাছ ধরার অনুমতিও নেই।
রাজশাহীর পবা উপজেলার নবগঙ্গা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য ২২ জন। তাদের সমিতির নিবন্ধনও আছে। নিবন্ধন নম্বর-১৩৭৪। কিন্তু এই সমিতির একজন জেলেও সরকারের খাদ্য সহায়তা পাননি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক আইনাল হক বলেন, ভারতীয়রা চোখের সামনে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা মাছ ধরতে পারছি না। সরকার আমাদের সহায়তাও করছে না। পঞ্চোশার্ধ জেলে আইনাল হকের ভাষ্যমতে, পদ্মানদীতে এবার এমনিতেই ইলিশ কম। তারপরও ভারতীয় জেলেরা ইলিশ শিকার করছেন। পেটে ক্ষুধা নিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা সেই দৃশ্য দেখছেন। তাদের ইলিশ তো দূরের কথা, জাল নিয়ে পদ্মায় নামারই অনুমতি নেই।
পদ্মায় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে মৎস্য অধিদপ্তর, নৌ-পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সম্মিলিতভাবে অভিযান চালাচ্ছে। গত মঙ্গলবার রাজশাহীর পদ্মানদীর বাবলাবন নামক স্থান থেকে দুই লাখ ২৫ হাজার মিটার অবৈধ কারেন্ট জাল জব্দ করে মৎস্য অধিদপ্তর ও নৌ-পুলিশ। পরে জালগুলো পাড়ে এনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এই অভিযানে ছিলেন নৌ-পুলিশের পরিদর্শক মেহেদী মাসুদ।
তিনি বলেন, বাবলাবন এলাকাটি একেবারেই সীমান্ত এলাকা। অথৈ পানি। সেখানে নির্দিষ্ট করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চিহ্নিত করা কঠিন। আমরা সেইখানে জেলেদের নৌকা নিয়ে জাল ফেলে মাছ ধরতে দেখি। সেদিকে এগিয়ে যাই। আমাদের দেখে জেলেরা জাল ফেলে ভারতের দিকে পালিয়ে যায়। আমরা জালগুলো তুলে নিয়ে আসি। জেলেরা ভারতে ঢুকে পড়ায় আটকের জন্য তাদের পিছু নেয়া যায়নি। পুলিশের এই কর্মকর্তার ধারণা, ওই জেলেরা ভারতীয়।
গেল বছর ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বালুঘাট এলাকায় ঢুকে পড়েছিলেন ভারতীয় জেলেরা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ায় মৎস্য কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তিন জেলেকে আটক করার চেষ্টা করে বিজিবি। তখন দুজন পালিয়ে যান এবং একজনকে আটক করে নদীর এপারে নিয়ে আসা হয়। আটক ব্যক্তি ভারতীয় নাগরিক বলে বিজিবি নিশ্চিত হয়। কিছুক্ষণ পর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের চার সদস্যের একটি টহল দল স্পিডবোট নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিজিবির টহল দলের কাছে আসে এবং আটক ভারতীয় নাগরিককে ছেড়ে দিতে বলে।
আটক ভারতীয় নাগরিককে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হবে বলে জানালে তারা ভারতীয় নাগরিককে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এতে বিজিবি সদস্যরা বাধা দিলে বিএসএফ সদস্যরা বিজিবির ওপর ছয় থেকে আটটি গুলি করেন। আত্মরক্ষার জন্য বিজিবির সদস্যরা গুলি চালালে বিএসএফ গুলি করতে করতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। এই গোলাগুলির ঘটনায় বিএসএফের এক সদস্য ওপারে যাওয়ার পর মারা যান। তারপর কয়েক মাস রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকার পর ভারতীয় ওই জেলে জামিন নিয়ে পালিয়ে যান।
গত বছর পদ্মায় ইলিশ ধরাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের আলোচিত ঘটনা ঘটলেও এবারও ভারতীয় জেলেরা আসছেন। রাজশাহীর পবা উপজেলা মৎস্য দপ্তরের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান বলেন, এবার নদীতে বাংলাদেশি জেলে পাওয়া যাচ্ছে না বললেই চলে। তবে অনেক সময় ভারতীয় জেলেদের নৌকা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তারা একেবারেই সীমান্ত এলাকায় থাকায় আমরা সেখানে যেতে পারছি না। অন্তত এক কিলোমিটার দূর থেকেই আমাদের অভিযান চালাতে হচ্ছে। তবে ইলিশ রক্ষায় দুই দেশ যদি সম্মিলিতভাবে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে ভাল হয়।
ভারতে এখন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় ‘মা ইলিশ রক্ষায় যৌথ সামুদ্রিক সহযোগিতা’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়ে জানানো হয়েছে, সাগরে আন্তর্জাতিক জলসীমার কাছাকাছি অবস্থানরত সমস্ত ভারতীয় মাছধরা নৌকাকে ভারতীয় সীমানার দিকে পাঠানো হচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, মা ইলিশ রক্ষায় এবং বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের চলমান প্রচেষ্টায় সহায়তা করার লক্ষ্যে ভারতীয় কোস্ট গার্ড আন্তর্জাতিক জলসীমার কাছাকাছি ভারতীয় মাছধরা নৌকা সরাতে নজরদারি বৃদ্ধি করছে। ভারতীয় হাইকমিশন বলছে, ভারত বিমানে নজরদারি করছে। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক জলসীমার কাছাকাছি অবস্থানরত ভারতীয় মাছধরা নৌকাকে ভারতীয় সীমানার দিকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। হাইকমিশন সাগরে এমন তৎপরতার কথা জানালেও দুই দেশের মধ্যে দিয়েই প্রবাহিত বড় পদ্মা নদীর দিকে কোন নজরদারি করা হচ্ছে কি না তা জানায়নি। স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়েও এমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে রাজশাহীর পদ্মানদীতে নৌ-পুলিশ, মৎস্য অধিদপ্তর ও বিজিবি দুই দেশের জেলেদের হাত থেকেই আপাতত ইলিশ রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বিজিবির রাজশাহীর ১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস জিয়াউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমরা সব সময় প্রস্তুত আছি। মৎস্য বিভাগ ডাকামাত্রই আমরা নদীতে অভিযানে যাচ্ছি। তথ্য নিয়ে দেখেছি, এবার পদ্মা নদীতে দুই দেশেরই জেলেদের উপস্থিতি কম।
এর কারণ হিসেবে বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, গত বছর নিষেধাজ্ঞার সময় একটা ঘটনা ঘটেছিল। বিএসএফ গুলিবর্ষণ করেছিল। আত্মরক্ষায় আমাদেরও গুলি করতে হয়েছিল। তাই সতর্কতার অংশ হিসেবে এবার কম জেলে আসতে পারে। ইলিশ রক্ষার জন্য আমাদের অবস্থান গতবছর যেমন ছিল, এবারও তেমনই আছে। সরকারি নির্দেশনা আমরা বাস্তবায়ন করব।