ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান দেশে ‘শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়’ ক্ষমতা বদলের সম্ভাবনা ‘দূরীভূত হয়েছে’ বলে মনে করেন। বুধবার ‘পার্লামেন্টওয়াচ: একাদশ জাতীয় সংসদ-প্রথম থেকে পঞ্চম অধিবেশন (জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০১৯)’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ওয়েবিনারে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, “অষ্টম ও নবম সংসদে সমস্যার মূল যে জায়গা সংসদ বর্জনের সংস্কৃতি অগ্রহণযোগ্য ছিল। সেটি বন্ধ হয়েছে চড়া দামে। এত বেশি চড়া দামে যে মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মত হয়েছে।’’
ইফতেখারুজ্জমান বলেন, “প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত নির্বাচনের সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। শান্তিপূর্ণ এবং স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা রদবদলের সম্ভানা দূরীভূত হয়েছে। তারই প্রভাব আমরা দেখতে পারছি জাতীয় সংসদের মধ্যে। এরই ধারাবাহিকতায় একাদশ সংসদে একদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছে।
যার ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে একচ্ছত্র ক্ষমতার সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। ফলে সংসদের মৌলিক দায়িত্ব আইন প্রণয়ন, সরকারের জবাবদিহিতা এবং জনপ্রতিনিধিত্ব- এই ৩টি ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা আমারা দেখতে পারছি না। ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সংসদের প্রথম বৈঠক বসে চলতি বছরের ৩০শে জানুয়ারি। দশম সংসদ বর্জন করা বিএনপি এই নির্বাচনে যোগ দেয়ার পর ঘটে নানা নাটকীয়তা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বে নির্বাচনী মহাজোট যেটি হয়েছিল, তারই একটি দলকে প্রধান বিরোধীদল হিসেবে পরিচিতি পেতে হয়েছে। সরকারকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে এই প্রধান বিরোধী দলের বাস্তব ও জোরালো ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনি। সংসদের মৌলিক যে ভূমিকা অর্থাৎ আইন প্রণয়নে সরকারি ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের মোটাদাগে আগ্রহ ও অংশগ্রহণ কম। অনেক ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সার্মথ্যও কম। সেটিরই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। সংসদীয় কমিটিসমূহ কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করেছে এরকম দৃষ্টান্ত বিরল।
সংসদীয় গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং শুদ্ধাচার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটিসমূহের যে অপরিহার্য ভূমিকা, তা কার্যকর হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। একইসঙ্গে সংসদীয় উম্মুক্ততার চর্চা কখনই খুব একটা ছিল না, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি আরো বলেন, “স্পিকারের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই কেবল আনুষ্ঠানিক মাত্রায় রয়েছে। এমনকি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি স্পিকারের অবস্থান থেকে। সংসদে আলোচনায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহের কতিপয়বিষয় পরোক্ষভাবে আসলেও বাস্তবে এসডিজিকে সামনে রেখে সুনির্দিষ্ট কোনো আলোচনা বা উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বিশেষ করে অভীষ্ট-১৬ যেখানে কার্যকর, জবাবদিহি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ও আলোচনা আমরা দেখতে পাইনি। তবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ যে প্রতিষ্ঠান নিজেই কার্যকর আছে কী-না, এ জাতীয় আত্মবিশ^াসের ঘাটতি বিদ্যমান, সেখানে সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মতো বিষয়সমূহ আলোচিত হবে সার্বিকভাবে আমরা তা আশাও করতে পারিনি।
ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআিইবি‘র ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মোরশেদা আক্তার ও নিহার রঞ্জন রায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে সংসদীয় কার্যক্রমে বিশেষত আইন প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা আরো জোরদার হয়েছে। সংসদীয় কার্যক্রমে আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আইন প্রণয়নের আলোচনায় সংসদ সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, অনাগ্রহ ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রথম ৫টি অধিবেশনে প্রধান বিরোধী দল কিংবা অন্য বিরোধী দলীয় বা স্বতন্ত্র সদস্যরা সংসদ বর্জন ও ওয়াকআউট করেননি। তবে ৫টি অধিবেশনের প্রতি কার্যদিবসে গড়ে কোরাম সংকট ছিল ১৯ মিনিট। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে অনুষ্ঠিত ৫টি অধিবেশনের প্রকৃত মোট সময়ের ১৭.৩০ শতাংশ সময় কোরাম সংকট ছিল। এই সময়ে মোট কোরাম সংকট ছিল ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট, যার প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ২২ কোটি ৮ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষত, প্রধান বিরোধী দল সতর্কতার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন কর্মকা-ের সমালোচনা করেছে। আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে প্রধান বিরোধী দলের সদস্যরা তুলনামূলকভাবে বেশি সক্রিয় থাকলেও তা প্রত্যাশিত পর্যায়ের ছিল না।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, প্রশ্নবিদ্ধ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ফলে সংসদীয় কার্যক্রম, বিশেষত আইন প্রণয়ন, বাজেট প্রণয়ন এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার চর্চা আরো জোরদার হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনকালীন মহাজোটের একটি দল নিয়মরক্ষার প্রধান বিরোধী দল হওয়ায় সরকারের জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় তাদের জোরালো ভূমিকার ঘাটতি লক্ষ করা গেছে।
সংসদীয় কার্যক্রমে আইন প্রণয়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলেও আইন প্রণয়নের আলোচনায় সংসদ সদস্যদের কম অংশগ্রহণ, অনাগ্রহ ও দক্ষতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। অধিকাংশ সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকর জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল।