গত তিন মাসে এক লাখের বেশি মানুষের যাওয়া আটকে গেছে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে । এদের অর্ধেকের বেশি ছুটি কাটাতে দেশে এসে ফিরতে পারেননি।
অন্যদিকে, মহামারি পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার আগ পর্যন্ত সৌদি আরব নতুন করে আর বিদেশি শ্রমিক নেবে না বলে খবর দিচ্ছে দেশটির গণমাধ্যম। যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো ঘোষণা বা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে জানানো হয়নি।
তবে, যাদের বৈধ পাসপোর্ট এবং আকামা বা কাজের অনুমতিপত্র আছে, তারা যাতে চাকরি না হারায় সেজন্য সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস দেশটির সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছে, বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
জুলেখা আর পারুলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
বগুড়ার জুলেখা বেগম গত আট বছর যাবত সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করেছেন। এরপর একটি কোম্পানিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি পেয়েছেন, আর সেখানে যোগদানের আগে হাতে দেড় মাস সময় ছিল, যে কারণে দেশে পরিবারের কাছে এসেছিলেন ফেব্রুয়ারিতে।
মার্চের ২৭ তারিখে তার ফিরে যাবার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু সাধারণ ছুটি আর বিমানযাত্রা বাতিলের কারণে আটকে যায় তার ফেরা।
‘গত তিন মাস ধরে বসে আছি, কবে যাইতে পারবো জানি না। তখন গেলে যে কোম্পানিতে এখন জয়েন করার কথা ছিল, তারা তখন আর আমাকে নেবে কি না তার তো কোন নিশ্চয়তা নাই। আর তারা না নিলে তখন আমার আকামা বাতিল হয়ে যাবে না কি অন্য কোন ব্যবস্থা হবে, বুঝতেছি না।’
জুলেখা বলছিলেন, ‘আমার এজেন্সি বলছিল জুন মাসের শেষে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে, কিন্তু এখনো তো কোন কিছু জানায় নাই তারা।’
নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ার পারুল আক্তার প্রথমবারের মতো সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছিলেন।
আকামা বা কাজের অনুমতিপত্র এবং বৈধ কাগজপত্রসহ সব কিছু নিয়ে তিনি তৈরি, আত্মীয়স্বজনের কাছে বিদায়ও চেয়ে রেখেছিলেন।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে মার্চের ২৩ তারিখ থেকে যাত্রীবাহী সব বিমান সংস্থার ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দেয় সরকার। সময়সীমা কয়েক দফায় বাড়িয়ে ৩০শে মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এদিকে, পয়লা জুন থেকে ফ্লাইট চলাচল শুরু হলেও পারুল কবে যেতে পারবেন এখনো জানেন না। ‘এজেন্সি থেকে বলছে, সৌদি আরবের সরকার বলছে করোনা না গেলে আমাদের নেবে না। এখন কবে করোনা যাবে আর আমরা যাইতে পারবো সেটা তো বুঝতেছি না।’
সৌদি আরবে যাওয়ার বন্দোবস্ত চূড়ান্ত হবার আগ পর্যন্ত একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন পারুল। এখন বিদেশ গমন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় তিনি বেকার হয়ে পড়েছেন। কী করবেন তা নিয়ে হতাশায় রয়েছেন।
জুলেখা বলছেন মেয়ে হলেও তার পরিবার তার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল, এখন রোজগার বন্ধ হয়ে পড়ায় পুরো পরিবারই অনিশ্চয়তায় ভুগছে। বাধ্য হয়ে মাসখানেক ধরে এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় রান্নায় সহায়তাকারীর কাজ নিয়েছেন।
কিন্তু দশ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে কাজ করা জুলেখা দেশে কাজ করতে চান না।
‘এখানে বেতন তো অনেক কম ওখানকার (সৌদি আরব) তুলনায়। সেই জন্য সৌদি আরবে যদি শেষ পর্যন্ত যাইতে না পারি, তাহলে অন্য দেশে যাবো, কাতার বা কুয়েত এ রকম কোন দেশে চলে যাবো।’
কত মানুষ আটকে পড়েছেন?
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের হিসাব অনুযায়ী এ বছর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের আগ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দুই লাখের বেশি অভিবাসী শ্রমিক ফেরত এসেছেন।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চে ফ্লাইট চলাচল বন্ধের আগ পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ৪১ হাজারের মতো শ্রমিক ফিরে এসেছেন। পরে চার্টার্ড বিমানে করে দেশে ফিরেছেন ১৩ হাজারের বেশি শ্রমিক, তারও একটি বড় অংশ সৌদি আরব থেকে এসেছে। এর বাইরে তিন মাসে সৌদি আরবে যাবার কথা ছিল এমন শ্রমিকের সংখ্যাও ৫০ হাজারের বেশি।’
বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৫০-৬০ হাজারের মতো মানুষ প্রতি মাসে বিদেশে কাজ করতে যায়, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটি যায় সৌদি আরবে। দেশটিতে জানুয়ারি মাসে গেছেন ৫২ হাজার মানুষ, ফেব্রুয়ারি মাসে গেছেন ৪৪ হাজার মানুষ, আর মার্চে ফ্লাইট বন্ধের আগ পর্যন্ত ৩৮ হাজার লোক গেছে।
এই মূহূর্তে সৌদি আরবে ২২ লাখের মতো বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিক কাজ করছেন।
সরকার কী বলছে?
সম্প্রতি সৌদি আরবের ইংরেজি দৈনিক সৌদি গেজেটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, মহামারির কারণে এ বছর সৌদি শ্রমবাজারে ১২ লাখ বিদেশি কর্মী চাকরি হারাবেন। রিপোর্টে দেশটির এক গবেষণা সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়, নির্মাণ খাত, পর্যটন (হজ), রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন খাতে এই কর্মচ্যুতি ঘটতে পারে।
এদিকে, বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলছেন, সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে কর্মী নিয়োগ বন্ধ বা ছাঁটাইয়ের মতো কোনো ঘোষণা বা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে জানানো হয়নি।
বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোর দায়িত্বে আছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এমন একজন কর্মকর্তা, যিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে তিনি জানিয়েছেন, সরকার ইতিমধ্যে রিয়াদ এবং জেদ্দায় আলাদা করে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে যাতে বাংলাদেশি কর্মীরা বিপদে না পড়েন।
তিনি জানিয়েছেন, কর্মকর্তারা জেদ্দা ও রিয়াদে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন, যাতে যাদের বৈধ পাসপোর্ট এবং আকামা আছে, তাদের চুক্তি যেন বহাল থাকে, যখনই তারা আসার সুযোগ পাক। বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আন্তঃমন্ত্রণালয় আলোচনা চলছে, যাতে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যায়।
তবে, যারা এখন সৌদি আরবে যেতে পারছেন না, তাদের সুরক্ষার জন্য সরকারের এখনি ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম।
তিনি বলেছেন, ‘যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে তারা যেতে পারছে না, সুতরাং তাদের করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে হবে।একই সঙ্গে যেহেতু তাদের বেশিরভাগই আর্থিক অসুবিধার মুখে রয়েছেন, তাদের সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। সরকারের উচিত তাদের নগদ অর্থ এবং খাদ্য সাহায্য দিয়ে সহায়তা করা।’
যারা যেতে পারছেন না, তাদের করণীয় কী?
সৌদি আরবে কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়েছে, দেশে থাকা এমন শ্রমিকের এখন কী করণীয় সে বিষয়ে বিবিসি সরকার এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে। তার ভিত্তিতে কিছু পরামর্শ:
১. সবার আগে সুস্থ থাকতে হবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে হবে, শারীরিক সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। সুস্থ না থাকলে সৌদি আরবসহ যেকোন দেশে বিমান ভ্রমণ করা যাবে না, এবং গেলেও চুক্তি বহাল থাকবে না।
২. আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
৩. বর্তমান পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির সাথে যোগাযোগ রাখুন, হালনাগাদ তথ্যের দিকে চোখ রাখুন।
৪. নতুন কোনো দক্ষতা অর্জনের চেষ্টা করুন।
৫. বিদেশে শ্রমিক হিসেবে নিজের অধিকার সম্পর্কে জানুন। সূত্র: বিবিসি বাংলা