সরকার করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অন্যান্যবারের চেয়ে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকালে বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া সংকটকালের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের রূপরেখা দিয়ে তৈরি এ বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৬৮ কোটি টাকা। এই বাজেট চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেশি। চলতি বাজেটের পরিমাণ পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ এক হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।

বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে এ বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী।

মহামারির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সংসদ সচিবালয় থেকে এবার একেবারেই অন্যভাবে বাজেট অধিবেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সংক্রমণ এড়াতে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু ব্যবস্থা। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, অধিবেশন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে কেবল কোরাম পূর্ণ হওয়ার (৬০ জন) ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের উপস্থিতি সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ৯০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে সংসদ থেকে এ অধিবেশনের একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অধিবেশনের মেয়াদ হবে ১২ কার্যদিবস। আগামী ৮ বা ৯ জুলাই অধিবেশন শেষ হবে। অধিবেশনে বাজেট পেশ হবে ১১ জুন। বাজেট পাস হবে ৩০ জুন। সম্পূরক ও মূল বাজেট নিয়ে ২০-২২ ঘণ্টা আলোচনা হবে বলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

এদিকে বাজেটকে ঘিরে বুধবার বিকাল ৫টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হয়েছে জাতীয় সংসদের অষ্টম অধিবেশন।

জানা গেছে, এ বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ৬৮ কোটি টাকা হলেও এর পরিবর্তনও হতে পারে। কেননা প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেওয়ার আগে বাজেটের কোনো অংকই চূড়ান্ত নয়। নিয়ম অনুযায়ী এবারের বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) পরিমাণ দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা ইতিমধ্যে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অর্থবিভাগ সূত্র জানায়, এবারের অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাজুড়ে থাকবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোভিড-১৯ এর প্রভাবের বিবরণ। থাকছে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার রূপরেখা। সরকার ইতিমধ্যে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলোও উল্লেখ থাকবে।

ইতিমধ্যে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সহায়তার বিবরণ এবং মানুষকে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সহায়তা দিতে যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ বাজেট বক্তৃতায় তুলে ধরবেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট বক্তৃতার একেবারে শেষাংশে তিনি কোভিড-১৯ পরবর্তী এক নতুন ভোরের স্বপ্নের কথা বলবেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প, এসএমইসহ সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষায় বাজেটে থাকবে দিকনির্দেশনা।

এবারের বাজেটকে সরকার কোভিড-১৯ পরবর্তী বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এতে কোভিড-১৯ এর পরবর্তী কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। এজন্য স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। একইভাবে সামাজিক সুরক্ষার আওতা ব্যাপকভাবে বাড়ানোর প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

নতুন করে করহার না বাড়িয়ে করজাল বিস্তৃতির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা থাকবে বাজেটে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে এবছর করপোরেট কর না বাড়িয়ে তা কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

বিশ্বব্যাংক আইএমএফ, এডিপিসহ প্রায় সব উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা পূর্বাভাস দিয়েছে এবছর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋণাত্বক পর্যায়ে চলে যাবে। এশিয়ায় অনেক দেশই ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধিতে চলে যাবে। তবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশ অর্জিত হবে বলে জানানো হয়েছে। যেটা সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আসছে বাজেটেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা রেখে বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটেও ৮ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হচ্ছে। আর বিশ্বব্যাপী ভোগ কমে যাওয়ায় এবং জ্বালারি তেলের দাম ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যাওয়ায় সামনের বছরে মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়েই থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য আসছে বাজেটেও ৫ দশমিক ৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতির টার্গেট ঠিক করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী।

এবারের বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে রেকর্ড পরিমাণ। কারণ কোভিড-১৯ এর প্রভাবে রাজস্ব আদায় কমে যাবে। এজন্য পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। ঘাটতির অর্থ সংস্থানের জন্য সরকার ব্যাংক থেকে ৮৮ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করতে যাচ্ছে। তবে কোভিড-১৯ এর কারণে আসছে বছওে বৈদেশিক সহায়তার হার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থবিভাগ সূত্র জানায়, আগামী বাজেটের মোট আকার হতে পারে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪৪ হাজার ৮১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেটে এডিপির আকার ইতিমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকার।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের বাজেটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। এজন্য আসছে বাজেটে জনগণের জীবন ও জীবিকা রক্ষার উদ্যোগ প্রতিফলিত হতে হবে। উন্নয়নকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে বরং মানুষের জীবন রক্ষার জন্য করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে সারাবিশ্বই এখন বিপর্যস্ত। ফলে বাজেটটা এমন হতে হবে যেখানে মানুষ সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হবে।’

মোট ব্যয়

আগামী অর্থবছরের বাজেটের মোট আকার ধরা হচ্ছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয়বাবদ খরচ ধরা হচ্ছে তিন লাখ ৬২ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেতন-ভাতাবাবদ ব্যয় রাখা হচ্ছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সরবরাহ ও সেবাবাবদ ব্যয়ে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণের সুদ পরিশোধবাবদ রাখা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা।

সরকারি প্রণোদনা, ভর্তুকি ও অনুদানবাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ থাকছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের বাজেটের আকার ধরা হয় পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। যা সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ধরা হয় পাঁচ লাখ এক হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা।

বাজেটের আয়

আগামী অর্থবছরের মোট রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আয় আসবে।

এনবিআর বহির্ভূত আয় ধরা হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা এবং ননট্যাক্সের রাজস্ব ১৫ হাজার কোটি টাকা। আয়ের দিক থেকে আগামী বছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে চার হাজার ১৩ কোটি টাকা।

বাজেটের ঘাটতি এবং অর্থায়ন

আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। এবারই প্রথম বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যার অন্যতম কারণ হচ্ছে কোভিড-১৯ এর প্রভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি।

বাজেটের ঘাটতির অর্থায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থকে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি অর্থায়নের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং বিদেশি উৎস থেকে ৭৭ হাজার কোটি টাকা আসবে বলে মনে সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎস বলতে ব্যাংক থেকে ৮৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য ঋণ নয়ো হবে আরও পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

এছাড়া ২০ কোটি ডলার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিশ্বব্যাংক এক বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তা সরবরাহ করবে। এডিবি ইতিমধ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটের কিছু অংশে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘চলমান সংকট নিরসনের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ থাকতে হবে। আগামী অর্থবছর বাজেটে ঘাটতি ঠিক রাখাই হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি হলে সমস্যা নেই।’

‘প্রতিবছর প্রবৃদ্ধির ৫ শতাংশ ধরেই ঘাটতি বাজেট নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ বছর অনুদান ছাড়া ৬ শতাংশ ধরা হয়েছে। তাতে সমস্যা নেই। আরও বেশি হতে পারত। তবে পরবর্তী সময়ে রাজস্ব আহরণের ওপর জোর দিতে হবে।’

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031