জানুয়ারির শুরুর দিকে খবর এলো নতুন এক রহস্যজনক ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে চীনের উহানে। নভেল করোনাভাইরাস গোত্রের নতুন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ল একে একে বিশ্বের নানা দেশে। বছরটা শুরু হয়েছিল আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন-সম্ভাবনায়। বাংলাদেশেও ৮ মার্চ এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম তিনজন রোগী শনাক্ত হয়।

ক্রমান্বয়ে রোগী বাড়তে থাকায় মার্চের শেষ দিকে এসে শুরু হলো লকডাউন বা ছুটি। অফিস কারখানা বন্ধে সৃষ্ট অচলাবস্থায় বিপুল ক্ষতি অর্থনীতির। বেড়েছে আগামী দিন নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা।

মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি জীবিকার চাকা কিছুটা হলেও সচল রাখতে ৬৬ দিন পর লকডাউন বা ছুটি তুলে নিয়েছে সরকার। কিন্তু ‘স্বাভাবিক’ কর্মকাণ্ডে ফেরার চেষ্টা থাকলেও দেশে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি এখন ঊর্ধ্বমুখী। ফলে মধ্য-নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন জীবিকা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী শুরুর পরই অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ছুটির পরে সীমিত পরিসরে চালু হলেও এখনো বন্ধ অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে অনেক কর্মীকে চাকরি হারাতে হয়েছে বা হচ্ছে এবং চাকরি থাকলেও বেতনের টাকা কর্তন যাচ্ছে। আবার ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এমন ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন সংকটে। গত তিন মাসে ঠাঁই বসে থাকার কারণে তাদের গুণতে হচ্ছে লোকসান।

সংকটে পড়া এমন চাকুরে কিংবা ছোট পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা করোনার প্রকোপের শুরুতেই স্ত্রী-সন্তান কিংবা পরিবারকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন বা রেখে এসেছেন। জীবিকার তাগিদে ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো নগরে থেকে যেতে হলেও বড় বাসা ছেড়ে উঠতে বাধ্য হয়েছেন মেসে। পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে- এরপর আবার পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকার মতো স্বচ্ছল অবস্থা থাকবে কি-না তা নিয়েও তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

মহামারীর ফলে সৃষ্ট এমন অবস্থা মানুষকে আর্থিক সংকটের পাশাপাশি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আফসানা আফরোজ মুন। বিশেষ করে মধ্য-নিম্ন আয়ের মানুষই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে তার ভাষ্য।

তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় সংকটে পড়া এসব মানুষের পরিবার কিংবা সন্তান সন্ততিরাও গ্রামের জীবনে মানিয়ে নিতে ধকলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে তাদের শিক্ষা জীবনের অনিশ্চয়তাও যোগ হয়েছে।’

মাসকুরা ইয়াসমিন চাকরি করতেন ঢাকার পল্টনের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ-এমবিএ করা এই কর্মজীবি নারী দুই বছর আগে মা-বাবাকে ঢাকায় এনে বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু করোনা মহামারী শুরুর পর এপ্রিল মাসে তার চাকরি চলে গেছে। ফলে বাসা ছেড়ে দিয়ে মা-বাবাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে তিনি নারীদের একটি মেসে উঠেছেন।

এই প্রতিবেদককে মাসকুরা বলেন, ‘এমন একটা সংকটে পড়বো ভাবতেই পারছি না। হাতে জমানো কোনো টাকাও নেই। চাকরি নেই হয়ে গেছে। ভাড়া দিতে পারবো না বুঝেই বাসা ছেড়েছি। জানি না এই পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে।’

কর্মজীবি এই নারীর মতোই জীবিকার সংকটে পড়েছেন শেখ তৈৗহিদ। একটি বিপনন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন তিনি। মে মাসে তাকে অফিস থেকে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়েছে। ফলে বেতন না থাকায় পরিবার নিয়ে ঢাকায় বাস করাটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে দুই সন্তানের পিতা তৌহিদের।

তিনি বলেন, ‘বিপদে পড়ে বাসার সব জিনিসপত্র সস্তায় বিক্রি করে দিয়ে পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয়েছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার চাকরিতে নেওয়া হবে। এখন তো তাদেরই আয় নেই, আমাদের চালাবে কিভাবে।’

বিশ্লেষক আফসানা আফরোজ মুনের মতে, মহামারী কিংবা দুর্যোগ নিয়ে কোনো পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই অচলাবস্থা কবে নাগাদ কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা হবে তাও বলা মুশকিল। সুতরাং মহামারী দিনের বাস্তবতাগুলো চিন্তা করেই জীবন জীবিকা নিয়ে সকলকে ভাবতে হবে।

লকডাউন বা ছুটি তোলার পর অর্থনীতির চাকা সেভাবে সচল হয়েছে বলে মনে করছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ছুটি তুলে নেওয়ার পর সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ায় মুভমেন্ট বেড়েছে, অর্থনীতিতেও কিছুটা গতি বেড়েছে। কিন্তু অর্তনীতির চাকা পুরোপুরি সচল হয়েছে সেকথা বলা যাবে না। আর স্বাাভাবিক অবস্থায় ফেরার সময় এখনও হয়নি।’

এদিকে মহামারীর কারণে দেশের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত রবিবার এক অনলাইন আলোচনা সভায় দেশীয় শিল্পকে অগ্রাধিকার দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিনিয়োগ বাড়াতে বিভিন্ন প্রণোদনা ও কর সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করেছেন তারা।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031