ভেন্টিলেটরের করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীর জন্য প্রয়োজন । সময়মতো ভেন্টিলেটর না পেলে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়। ইতিমধ্যে এমন ঘটনাও ঘটেছে। অথচ দেশে ভেন্টিলেটর সংকট তীব্র। এ অবস্থায় ভেন্টিলেটর আমদানির উদ্যোগও নেয়া হয়। কিন্তু আমদানিতেই দুর্নীতির আভাসে ক্রয়াদেশ হয়নি তিন মাসেও। দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য ভেন্টিলেটর রয়েছে ১২৬৭টি। বর্তমানে সরকারিভাবে ঘোষিত রোগী ৬০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এছাড়া, শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছে আক্রান্তদের একটি বড় অংশ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, আক্রান্ত রোগীদের অন্তত ৫ ভাগের ভেন্টিলেটর সাপোর্ট প্রয়োজন। প্রয়োজনের সময়ে অনেকেই ভেন্টিলেটর সাপোর্ট পাননি। ভবিষ্যতে যে রোগী সংখ্যা আরো বাড়বে তাও স্পষ্ট।
তীব্র সংকট মোকাবিলায় ভেন্টিলেটর আমদানির পরিকল্পনাও নেয়া হয়। কিন্তু ক্রয়াদেশ দেয়া হয়নি। ভেন্টিলেটর আমদানির আগেই সেখানে দুর্নীতির কালো হাত দেখা যায়। বিস্ময়কর হলো, এই ক্রয়ের সঙ্গে খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে একটি ইংরেজি সংবাদপত্র। ঢাকা ট্রিবিউন সম্পাদক জাফর সোবহান ফেসবুকে তারই প্রতিবেদকের করা একটি প্রতিবেদন ট্যাগ করেছেন। এর শিরোনামেই প্রশ্ন: ভেন্টিলেটর আমদানি নিয়ে কী ঘটলো? এর উত্তর: স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের একটি সূত্র বলেছে, দুর্নীতির কারণে কার্যাদেশ দিতে দেরি হচ্ছে। করোনাকালের ১২ সপ্তাহেও এই আদেশ দেয়া যায়নি। অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির কারণে আটকে আছে ভেন্টিলেটর আমদানি। দেয়া যাচ্ছে না কার্যাদেশ।
২রা জুন প্রকাশিত ইমপেরিয়াল কলেজ লন্ডনের এমআরসি সেন্টার ফর গ্লোবাল ইনফেকশিয়াস ডিজিজ এনালাইসিস ‘সিচুয়েশন রিপোর্ট ফর কোভিড-১৯: বাংলাদেশ, ২০২০-০৬-০২’- শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০শে জুনের মধ্যে করোনা রোগীর চিকিৎসায় উচ্চ চাপযুক্ত অক্সিজেন সমৃদ্ধ বেডের চাহিদা ২৩৮০ থেকে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৯,৮৪৮-এ। পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে আইসিইউ বেডের চাহিদা ৭১১ থেকে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৫২৫৪টি। এসব বেডে চিকিৎসা দিতে থাকতে হবে মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন।
এপ্রিলের শেষদিকে স্ব্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪০০ থেকে ৫শ’ ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন জেনারেটর আনতে তারা কাজ করছেন। ৯ই এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস রিলিজে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বরাতে বলা হয়, ৩৮০টি নতুন ভেন্টিলেটর আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু মে মাসের শেষ পর্যন্ত কোনো হাসপাতালের আইসিইউতে কোনো নতুন ভেন্টিলেটর যুক্ত করা হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান খান বলেন, প্রায় দুইশ’ ভেন্টিলেটর যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি প্রক্রিয়াধীন আছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তা পাবো বলে আশা করছি। এই ভেন্টিলেটর কেনার অর্থ যোগান দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কারণে এখানে বিলম্ব ঘটেছে। আরেকটি আমদানির উদ্যোগ দুর্নীতির কারণে ভেস্তে গেছে। অতিরিক্ত সচিবই বলেছেন, এখনও কার্যাদেশ দেয়া হয়নি।
ওদিকে করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতেও সম্ভাব্য দুর্নীতির কিছু ছবি বিস্ময় তৈরি করেছে। অবাক করা বিষয় করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে যেসব সরঞ্জাম বিশেষ প্রয়োজন, সেই বিশেষ সরঞ্জাম নিয়ে দুর্নীতির ফন্দি আঁটা হয়। সরকারের নিজস্ব টাকা নয়, ঋণের টাকায় ভাগ বসাতে চেয়েছে মহলটি। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এ ঋণ দিয়েছে পিপিই, ভেন্টিলেটর, মাস্ক, গগলসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার জন্য। আর এ ঋণ নিয়ে এসব উপকরণ কেনার উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় যে খরচ ধরা হয়েছে, তা বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। করোনাকালের শুরু থেকেই দেশের স্বাস্থ্য খাতের করুণ অবস্থা ধরা পড়ে সবার চোখে। পর্যাপ্ত আইসিইউ’র অভাবে করোনায় আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছে। মানসম্পন্ন পিপিই নিয়েও হইচই হয়েছে হাসপাতালে হাসপাতালে। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের অভাবে করোনায় আক্রান্তদের সেবা দিতে অপারগতা জানান অনেক চিকিৎসক। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি ঋণ দেয়। যা দিয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় যে খরচ ধরা হয়েছে, তা বাজারমূল্যের চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি। দু’টি প্রকল্পে এমন চিত্র দেখে আপত্তি জানায় পরিকল্পনা কমিশন। কিন্তু তাতেও খরচ কমানো যায়নি।
সূত্র মতে, করোনা সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে একনেক সভায় দু’টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১১১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ৮৫০ কোটি টাকা। বাকি ২৭৭ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে আরেকটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে এডিবি’র অর্থায়নে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১৩৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবি’র ঋণ ৮৫০ কোটি টাকা। বাকি ৫১৫ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। এরই মধ্যে দু’টি প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে।
সূত্র
জানিয়েছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেয়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জরুরি
সহায়তা শীর্ষক শিরোনামের প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ সেফটি গগলস কেনা হবে।
প্রতি সেফটি গগলসের দাম ধরা হয়েছে ৫০০০ টাকা। মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫০ কোটি
টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে প্রতি সেফটি গগলস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ১০০০
টাকায়। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় মোট এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিপিই কেনা
হবে। যার প্রতিটির জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৪৭০০ টাকা। পিপিই কেনায় মোট খরচ হবে
৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি ভালো
মানের পিপিই বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দুই হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় ৭৬
হাজার ৬০০ জোড়া বুট সু কেনা হবে। প্রতিটি সু’র খরচ দেখানো হয়েছে এক হাজার
৫০০ টাকা। এই খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। দেশে বর্তমান
বাজারে বুট সু ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়,
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে করোনা মোকাবিলার প্রকল্পে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার
চেয়ে সফ্টওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাতে তুলনামূলক
বেশি খরচ হচ্ছে। গবেষণার জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
ইনোভেশন নামের আলাদা একটি খাত তৈরি করে সেখানে ৩৬ কোটি টাকা খরচ করার কথা
উল্লেখ করা হয়েছে। চলমান করোনা সংকটের মধ্যে যেখানে সবকিছু স্থবির, সেখানে
এই প্রকল্পে ভ্রমণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। মাত্র ৩০টা
অডিও-ভিডিও ফিল্ম তৈরির খরচ দেখানো হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৮০টা
সেমিনার ও কনফারেন্স করে খরচ করা হবে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। অস্বাভাবিক
খরচ দেখানো হয়েছে ওয়েবসাইট উন্নয়ন খাতে। মাত্র চারটি ওয়েবসাইট উন্নয়ন করতে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খরচ হবে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি ডাটাবেইস তৈরিতে
খরচ দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি কম্পিউটার সফ্টওয়্যার
কেনায় খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩০টি রিসার্চ অ্যান্ড
ডেভেলপমেন্টের জন্য খরচ ধরা হয়েছে আরো ৪৫ কোটি টাকা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে
করোনায় আক্রান্ত রোগীদের আনা-নেয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে
৩৭ কোটি টাকা। দেশে সকল স্থলবন্দরে যাতায়াত করা মানুষের শরীরের তাপমাত্রা
দেখতে নির্মাণ করা হবে অনাবাসিক ভবন। সেসব ভবন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে
১৯০ কোটি টাকা। এডিবি’র অর্থায়নে নেয়া প্রকল্পেও একই চিত্র দেখা গেছে। তবে
এডিবি’র অর্থায়নে প্রকল্পের আওতায় অগ্রগামী যোদ্ধা চিকিৎসক ও নার্সদের
ঝুঁকিভাতা হিসেবে ৩৩৫ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের
করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে পদ অনুযায়ী প্রণোদনা ঘোষণা করেছে
সরকার। করোনা দুর্যোগ মুহূর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ দুই প্রকল্পের
ব্যয়ের চিত্র দেখে একে তামাশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের
কথা- এমন দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তেও যারা দুর্নীতির চিন্তায় মগ্ন তাদের দিয়ে
কী আশা করা যায়।