কম জল ঘোলা হয়নি সরকারি হাসপাতালে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ করা নিয়ে। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে একটি ভিডিও কনফারেন্সে ভুল বা নকল মাস্ক সরবরাহ না করার ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর এ নিয়ে বিভিন্ন তদন্ত সংস্থাসহ নড়েচড়ে বসে সব মহল। যদিও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীই প্রথম নকল মাস্ক সরবরাহকারীদের ভিত নাড়িয়ে দেন। মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হিসেবে তিনিই প্রথম সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের চিঠি লেখেন এবং বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে আলোড়ন তোলেন।
সামাজিক গণমাধ্যমে যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে ও তাঁর বন্ধুকে নিয়ে সমালোচনামূলক নানা খবর দেখেছি তখন একে প্রথম চক্করে আমল দিতেই চাইনি। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক মহলের দুরভিসন্ধি কিংবা নিছক ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরকম প্রচারণা কি না এমনটাই মনে হয় তখন। কিন্তু যখন খোদ একজন দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তা যিনি কি না কেন্দ্রীয় ঔষধ সরবরাহ দপ্তরের (সিএমএসডি) দায়িত্বে ছিলেন তিনি যখন মন্ত্রী-পুত্রের ব্যবসায়িক যোগ নিয়ে কিছু বলেন তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই নড়েচড়ে বসতে হয় বৈকি।
ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কেনাকাটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সিএমএসডিতে অনিয়ম, দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। এমন অভিযোগ ছিল। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু এবার হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন সেই সিএমএসডিতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল্লাহ।
খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেওয়া চিঠিতে কোভিড-১৯ মাস্ক ও যন্ত্রপাতি সরবরাহে, সিন্ডিকেটের কথা তুলে ধরে অভিযোগ দিয়েছেন এই সেনা কর্মকর্তা। চিঠির অনুলিপিও দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দপ্তরে। চিঠিতে কেনাকাটার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে ও মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের অযাচিত সুপারিশের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন, স্পর্শকাতর এবং অভিনব বটে। এমন একটি গুরুতর অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব তদন্ত সংস্থার একযোগে নেমে যাওয়া উচিত। বিষয়টি দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত সত্য জনসম্মুখে প্রকাশ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সেনাবাহিনীর মতো একটি সুশৃঙ্খল ও নীতির ব্যাপারে অত্যন্ত কঠিন-কঠোর একটি সংস্থার পদস্থ একজন কর্মকর্তা স্রেফ অতি আবেগের বশে কোনো অভিযোগ করেছেন এমনটি অন্তত আমি মনে করি না। বরং সিএমএসডিতে দুর্নীতির শেকড় যে অনেক গভীরে এবং সেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের ইচ্ছে পূরণ করতে না পারলে যে পরিণতি সুখকর হয় না তা আরও একবার পরিষ্কারভাবে দেখার সুযোগ আমরা পেলাম সেনা কর্মকর্তার অভিযোগ প্রকাশ্যে এসে যাওয়ায়।
স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা দীর্ঘকালের। অতীতের বিভিন্ন আমলের মতো বর্তমান মন্ত্রী-সচিব এই দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে ধীরে চলো নীতি নিয়ে এগোচ্ছেন কি না এমন প্রশ্ন শুরু থেকেই রয়েছে। বিশেষত কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি, অব্যবস্থাপনা, নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ, মানহীন পিপিই দেওয়া নিয়ে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ, অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। অতি উচ্চমূল্যে মানহীন চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কেনায় সব মহলে যখন বিতর্কের ঝড় উঠে তখন মন্ত্রী ও সদ্য বদলি হওয়া সচিবকে কার্যত নির্বিকার থাকতে দেখেছি আমরা। সাধারণ মাস্ককে এন-৯৫ মাস্ক হিসাবে চালিয়ে দেওয়া, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জেএমআইকে কার্যত ছাড় দেওয়ায় নানামুখী প্রশ্ন ওঠে। নিন্দুকেরা বলতে শুরু করেন জেএমআই-এর ব্যবসায়িক লাভের গুড় অন্য কেউ খাচ্ছে কি না। যারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক প্রশাসনিক প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠজন। সিএমএসডির সদ্য বিদায়ী পরিচালকের লিখিত অভিযোগে অনেক কিছুর ইঙ্গিত মিলছে নকল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহকারী জেএমআই-এর মালিক আব্দুর রাজ্জাক কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। কিন্তু শুধুমাত্র ভুল স্বীকার করে ওই প্রতিষ্ঠানটি কেন পার পেয়ে যাবে? এটি আমাদের জানা প্রয়োজন। যেখানে মানহীন মাস্ক ব্যবহার করে চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীর শতভাগ জীবনের ঝুঁকি ছিল সেখানে আমলযোগ্য অপরাধের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিশ্চুপ থাকা অস্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে হয়। যেখানে সিএমএসডি থেকে লিখিতভাবে চিঠি দিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ পর্যন্ত জানানো হয়েছিল সেখানে মন্ত্রণালয়ের নীরবতা রহস্যজনকই বটে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কেনাকাটার দায়িত্বে থাকা সিএমএসডিতে যে ‘মধু’ আছে একথা বিভিন্ন সময়ে শুনে এসেছি।
মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কেউ কেউ সেই ‘মধু’ আরোহণে নানাজনকে কাজে লাগিয়েছেন। কান পাতলেই সে কথা শোনা যায়। অমুক সিন্ডিকেট, তমুক সিন্ডিকেটের কথাও আমরা বিভিন্ন সময় ধরে শুনে আসছি।
সিএমএসডিতে সিন্ডিকেট যে আছেই তা স্পষ্ট করে দিলেন সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল্লাহ। প্রথা ভেঙে খোদ গণমাধ্যমের সামনে হাজির হয়ে তিনি বললেন, সিএমএসডিতে সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা না করায় তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে।
কী সাংঘাতিক কথা! একজন শৃঙ্খলাপরায়ণ বাহিনীর সদস্য কি না প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ আনলেন যা কি না দীর্ঘদিনের প্রায় প্রতিষ্ঠিত একটি সত্য বিষয়। নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে এই সত্যই এখন উদঘাটিত হবে, দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম, দুর্নীতির সাথে জড়িতরা চিহ্নিত হবে এবং বিচারের আওতায় আসবে এটা কি খুব বেশি চাওয়া।
প্রসঙ্গত, গত ২০ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে সিএমএসডির পরিচালক পদে পদায়ন করা হয়। দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে সেনাবাহিনীর একজন চিকিৎসক কর্মকর্তার পরিবর্তে প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তার এই পদায়ন নিয়ে হৈ-চৈ করে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। এই দুই সংগঠন ওই দিনই জনপ্রশাসন সচিবকে চিঠি দিয়ে এই পদায়নের বিরোধিতা করে। যদিও প্রশাসন ক্যাডারের যে অতিরিক্ত সচিবকে সিএমএসডির নতুন পরিচালক করা হয়েছে তিনি একজন সৎ, আপোসহীন ও দৃঢ়চিত্তের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। স্বভাবতই নতুন এই পদায়ন নিয়ে অধিকতর আলোচনাই নানা কৌতূহলের জন্ম দেয়।
আর এর মধ্যেই বিদায় নেওয়ার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে বদলি হওয়া সিএমএসডি পরিচালক প্রতিষ্ঠানটিতে অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যান। চিঠিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুল ইসলামের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ওই অতিরিক্ত সচিব বলেছেন এটি স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর তার ছেলের অনুরোধ। তাদের পাঠানো তালিকা ও দ্রব্যাদি অনুযায়ী কেনাকাটা করতে হবে। বিদায়ী পরিচালকের চিঠি অনুযায়ী তিনি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের পরামর্শ অনুযায়ী কেনাকাটা করেননি। তাই তাকে বদলি হতে হয়েছে। বিদায়ী পরিচালকের ভাষ্য অনুযায়ী, “সিন্ডিকেটের সঙ্গে মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বাজেট সংগ্রহসহ প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান তৈরি করা হয়। এই সিন্ডিকেট সিএমএসডিতে দীর্ঘদিন আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। এতে সরকার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হচ্ছে। ক্রয়-প্রক্রিয়া এই সিন্ডিকেটের মনঃপূত না হলে ক্রয় বাতিল বা দীর্ঘায়িত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রয়োজনে কর্মকর্তার বদলিসহ বিভিন্ন হুমকি প্রদান করে।”
স্বাস্থ্য খাতে বহুদিন ধরেই আমরা সিন্ডিকেটের কালো থাবার কথা শুনে আসছি। করোনা ভাইরাসের ভয়ে সবাই যখন জবুথবু তখনও স্বাস্থ্য খাতের সিন্ডিকেট আগের মতোই ভয়ংকর রূপ নিয়ে সক্রিয়! জনস্বাস্থ্য যখন এক নম্বর প্রায়োরিটি তখনও দেশের অনেক চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীকে দেওয়া হয় নিম্নমানের ফেস মাস্ক। সরবরাহকারী স্রেফ ভুল স্বীকারের চিঠি দিয়ে মাফ পেয়ে যায়। প্রশ্ন তো তাই জোরেশোরেই উঠছে। স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন কেনাকাটায় সরবরাহকারী কারা? কি তাদের পরিচয়? ঘুরেফিরে বিশেষ কয়েকটি গোষ্ঠীই নাকি সিএমএসডিসহ স্বাস্থ্য খাতের সব কেনাকাটায় সরবরাহকারী থাকে। এসব কেনাকাটায় কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়? কতটা স্বচ্ছতা থাকে? দুদকের অনুসন্ধান এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
আগামী জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট আরো বাড়বে এমন আভাসই মিলছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বৃদ্ধিও হবে। নতুন যন্ত্রপাতি, স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি কেনা হবে। এসব কেনাকাটায় আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হবে স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত সব পুরোনো সেই সিন্ডিকেটগুলোই। না-কি জনগণের ট্যাক্সের টাকা নয়ছয় বন্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হবে? সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালক যেভাবে দুর্নীতির কথা বলে গেলেন তা শুধুই বদলিজনিত হতাশার প্রতিক্রিয়া হিসেবে না দেখে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান অতি দ্রুত শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয়। না হলে সরকারি প্রশাসনে শৃঙ্খলা বলে কিছু আর থাকবে না। আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও অভিযোগ করেছেন যে, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় বিদায়ী সিএমএসডি পরিচালককে সরানো হয়েছে। যদি দুর্নীতির বিষয়টিই সঠিক হয় তাহলে শুধু বদলি কেন? বদলি তো কোনো শাস্তি নয়। আমরা চাই সিএমডিতে দুর্নীতি না হোক, মানসম্পন্ন ওষুধ, স্বাস্থ্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ নিশ্চিত হোক। নতুন পরিচালক নিশ্চয়ই দুর্নীতির সকল সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে নতুন দিনের শুরু করবেন। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সাপ্তাহিক এই সময়।