প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি খোলা চিঠি লিখেছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-সহ দেশ-বিদেশের ৫টি সংগঠন। এতে করোনা ভাইরাস মহামারির সময় বাংলাদেশে সাংবাদিক সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য ৩টি প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনগুলো। চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, ২০১৮ সালের ১৯শে নভেম্বর সংকটে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করা একটি সংগঠনকে তহবিল প্রদানের সময় আপনি বলেছিলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।’ আপনি আরো বলেছিলেন, ‘কেউ বলতে পারবে না আমরা কখনও কারও কণ্ঠরোধ করেছি; আমরা কখনও তা করিনি এবং কখনও তা করবো না।’ তবু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আপনার দাবির সঙ্গে তথ্য সাংঘর্ষিক। আপনার ওই বক্তব্যের পর আরএসএফ কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশের ৫ ধাপ অবনতি হয়েছে। ২০২০ সালের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১তম। আর গত কয়েক সপ্তাহে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ঘটনায় আমরা আশঙ্কা করছি, আগামী বছরে বাংলাদেশের আরো অবনতি হতে পারে। শুধু মে মাসেই ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তত ১৬ সাংবাদিক ও ব্লগারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদের মধ্যে গত ৬ই মে বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমন সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) কর্তৃক গ্রেফতার হন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। তার একমাত্র ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ ছিল ‘লাইফ ইন টাইম অব করোনা’ শিরোনামে রাজনীতিকদের নিয়ে একটি কার্টুন সিরিজ প্রকাশ করা।
তিনি এখনও কারাবন্দি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হতে পারে তার। এই আইনে গ্রেফতার হওয়া বেশিরভাগ সাংবাদিক শুধু এমন তথ্য প্রকাশ করেছেন, যা স্থানীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে গেছে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি ছুটি শুরুর পর অন্তত ১৩ সাংবাদিক পরিকল্পিত সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কয়েকটি ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন তারা। গত ১লা এপ্রিল শাহ সুলতান আহমদ নামের সাংবাদিককে লোহার রড দিয়ে মারধর করা হয়। মহামারিতে সরকারের পাঠানো জরুরি খাদ্য সহায়তা বিতরণে অনিয়মের খবর প্রকাশের কারণে স্থানীয় এক রাজনীতিক প্রতিশোধ নিতে মারধরের নির্দেশ দেয়ায় ঘটনাটি আরো ভয়ংকর রূপ নেয়। আরএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মানবিক ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত জেলা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের কারণে আরো ৬ সাংবাদিক একই ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। জাতিসংঘ এই সময়কে ‘ভুল তথ্যের মহামারি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এমন সময়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা নাগরিকদের নির্ভরযোগ্য ও স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন তৈরিতে সামনে থেকে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের সহিংসতার শিকার হওয়া মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবাদিকোচিত স্বাধীনতা সুরক্ষা এবং শারীরিক বা বিচারিক প্রতিহিংসার আতঙ্ক ছাড়াই যেন সাংবাদিকরা কাজ করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে আপনার সরকারের কর্তব্য রয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় কাজ করা বাংলাদেশি ও আন্তর্জাতিক ৫টি সংগঠন প্রধানমন্ত্রী ও তার নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে কয়েকটি আহ্বান জানিয়েছে। এগুলো হল- সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলা চালানো ব্যক্তিরা যেন বিচারহীন না থাকে সেজন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষ থেকে তদন্তের নির্দেশ এবং প্রয়োজনে হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের গ্রেফতার ও বিচার করা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিক, ব্লগার ও কার্টুনিস্টদের অবমাননাকর শাস্তির ধারা বাতিল করা। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার আইন সংস্কার করা, যাতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ২০১৮ সালের ১৪ই মে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হয়। এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার করা উচিত এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষায় একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করা দরকার। চিঠিতে স্বাক্ষরকারী অন্য ৪ সংগঠন হলো- ফোরাম ফর ফ্রিডম এক্সপ্রেশন (মুক্ত প্রকাশ), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), কার্টুনিস্ট রাইটস নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল (সিআরএনআই) এবং কার্টুনিস্ট ফর পিস (সিএফপি)।