দুই সন্তানের জননী। আলো। ২২ বছরের যুবতী। বড় সন্তানের বয়স ৪ বছর আর ছোটটার ১ বছর ৬ মাস। থাকেন মোহাম্মদপুরের চল্লিশ বস্তিতে। স্বামী গাড়ি চালক। তার আয়-রোজগারের টাকা নেশা আর জুয়ার পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ১
পেছনেই চলে যায়। তাই সংসার সামলাতে হয় আলোকেই।
সঙ্গে স্বামীর নেশার টাকারও যোগান দিতে হয় মাঝেমধ্যে। আলো
অন্যের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। সেই টাকা দিয়েই সবকিছু ম্যানেজ করতে হয় তাকে।
সংসারে স্বামী-সন্তান ছাড়াও রয়েছে শাশুড়ি। এমন গদবাঁধা জীবনযাপন-ই আলো’র।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সেই জীবনও দুর্বিষহ হয়ে ওঠেছে তার।
বাসাবাড়িতে কাজ বন্ধ। কাজ নেই তার স্বামীরও। ফলে এদিক-ওদিক করে, খেয়ে-না
খেয়ে সন্তানদের নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তিনি। অন্যদিকে স্বামীর নেশার টাকা
যোগান দিতে না পারায় তার ওপর মাঝে মাঝেই নেমে আসছে শারীরিক নির্যাতন। শুধু
স্বামীই নয়, তার ওপর নির্যাতনের খড়গ চালায় শাশুড়ি এবং ভাসুরও। আলোর ভাষ্য,
তাকে যখন নির্যাতন করা হয়, তখন তাদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। পা থেকে মাথা
পর্যন্ত চলে অমানুষিক নির্যাতন। সেই নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট তার শরীরে।
করোনা পরিস্থিতিতে আলো একাই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন তেমনটা
নয়, তার মতো একই পরিণতি ভোগ করছেন ৯৬ শতাংশ বস্তিবাসী নারী।
এমন
ভয়াবহ চিত্র তুলে এনেছে নারী শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা
সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা ‘বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে)।’
মোহম্মদপুর অঞ্চলের পাঁচটি বস্তিতে জরিপ চালিয়ে এ তথ্য দিয়েছে সংস্থাটি।
বস্তিগুলো হলো- চল্লিশ বস্তি, পোড়াবস্তি, জেনেভা ক্যাম্প, বিজলি মহল্লা এবং
জহুরি মহল্লা। বর্তমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে লকডাউন চলাকালে গত ২৪শে
মার্চ থেকে ২০শে এপ্রিল পর্যন্ত জরিপটি পরিচালিত হয়। জরিপে করোনাভাইরাস
পরিস্থিতিতে বস্তিবাসী নারী ও বস্তির পরিবেশ, করোনার বিষয়ে তাদের
ধ্যান-ধারনা, সচেতনা, সুরক্ষা ব্যবস্থা, খাদ্য ব্যবস্থা, লকডাউনের আগে ও
লকডাউন চলাকালীন তাদের অবস্থান, কর্মসংস্থান ইত্যাদি নানা বিষয় তুলে আনা
হয়েছে। ‘বস্তিবাসী কর্মজীবী নারীদের ওপর করোনার প্রভাব’ শিরোনামে পরিচালিত
জরিপে জীবিকা ও খাদ্যসুরক্ষা, কোভিড-১৯ রোধ ও সুরক্ষা, নারীদের বিরুদ্ধে
সহিংসতা এবং নারীদের সামাজিক সুরক্ষা ও অন্তর্ভূক্তি- এই চারটি বিষয়কে
প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বিএনএসকে বস্তির ২২০ নারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। সংস্থাটি ঢাকার বস্তি ও মানিকগঞ্জের দরিদ্র ১০০০
পরিবারকে ২ মাসের এবং প্রতিদিন ২৫০ জনকে তিন বেলা পুস্টিকর খাবার দিয়ে
যাচ্ছে। এছাড়া পথশিশু, ট্রান্সজেন্ডার, সুবিধাবঞ্চিত স্কুল শিশুদের খাবার
সরবরাহ করছে। এই করোনাকালে প্রকৃত অর্থে যাদের প্রয়োজন দলমত-নির্বিশেষে
তাদের বাছাই করে এসব সহায়তা দিচ্ছে তারা।
বিএনএসকে’র প্রতিবেদন
অনুযায়ী, বস্তিবাসী ৯৪ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন এবং দিন এনে
দিন খান। ৮৬ শতাংশ গৃহকর্মী, বুটিক শ্রমিক, রাস্তার বিক্রেতা এবং
পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং ১৪ শতাংশ পোশাক শ্রমিক। জরিপে অংশ নেয়া ৬৭ শতাংশ
নারী পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী, ৩৩ শতাংশ নারী সহ-উপার্জনকারী। ৯৫ শতাংশ
নারীর জীবনসঙ্গী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। যেমন দৈনিক শ্রমভিত্তিক,
রাস্তার বিক্রেতা এবং মোটর মেকানিক্স। ৯০ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা
প্রতিমাসে এক হাজার থেকে দশ হাজার টাকা উপার্জন করেন, যা তাদের প্রাথমিক
চাহিদা যেমন- খাদ্য, আবাসন, শিশুদের পড়াশোনার ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষা
ইত্যাদি চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে খুবই অপ্রতুল ।
করোনা মহামারীর কারণে
চাকরি হারিয়েছেন ৯৪ শতাংশ নারী। তারা জানান, করোনা পরিস্থিতি পরিবারের
উপার্জনক্ষম সব সদস্যকেই প্রভাবিত করেছে। পরিবারের সব উপার্জনকারী কাজ
হারিয়েছেন বা সাময়িকভাবে কাজ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। জরিপে অংশ নেয়া শতভাগ
নারী জানিয়েছেন, তাদের কোন সঞ্চয় নেই। লকডাউনের কারণে বস্তির ৯২ শতাংশ
কর্মজীবী তাদের শেষমাসে (মার্চ) মজুরি পাননি। ৯৮ শতাংশ নারী জানান, পরবর্তী
দু’সপ্তাহের জন্য খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার অর্থ নেই, কারণ এই
পরিস্থিতিতে তাদের কাজে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। স্বল্প আয়ের ৮৫ শতাংশ নারী
জানান, তাদের খাদ্যসহায়তা খুব প্রয়োজন। ৪০ শতাংশ বয়স্ক কর্মী শারীরিক
অসুস্থতায় জন্য নিয়মিত যে ওষুধ খান তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
কোভিড-১৯
সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের আলোকে জরিপে ওঠে এসেছে মাত্র ২২ শতাংশ নারী
করোনাভাইরাস এবং এর সংক্রমণের লক্ষণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন।
আংশিকভাবে জানেন ৫৬ শতাংশ আর বাকি ২২ শতাংশ জানে না বললেই চলে। ৭৬ শতাংশ
বস্তিবাসী সংক্রমণের বিপদ এবং সংক্রমণের মাধ্যম সম্পর্কে জানেন-ই না। করোনা
প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্পর্কে জানেন ৫০ শতাংশ নারী। যেমন- ফেস
মাস্ক ব্যবহার করা, সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ইত্যাদি। যেখানে বাকিরা ব্যক্তিগত
সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। মহামারী এ করোনাভাইরাসের
লক্ষণ প্রকাশের পর চিকিৎসা সম্পর্কে ১৭ শতাংশ নারী পুরোপুরি জানেন, ৬২
শতাংশ আংশিক এবং ২১ শতাংশ নারীর তেমন কোনো ধারণা নেই। ৭৮ শতাংশ খাওয়ার আগে
এবং টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সম্পর্কে জানেন, তবে তারা
পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতা উপাদানের অভাবে সবসময় সাবান ব্যবহার করেন না।
বিএনএসকে’র
জরিপে ভয়ঙ্কর যে বিষয়টি ওঠে এসেছে, তা হলো নারীর প্রতি সহিংসতা। ৯৬ শতাংশ
নারী জানিয়েছেন, মহামারী করোনার সময়ে তারা তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্য
দ্বারা শারীরিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কেউ কেউ বলেছেন, পরিবারের পুরুষ
সদস্যরা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় মানসিক চাপে থাকা এবং বাইরে জুয়া খেলা ও
মাদকসেবন করতে না পারায় নারীদের প্রতি সহিংসতা বাড়িয়েছে। এসব পুরুষ
সদস্যের দ্বারা বাচ্চারাও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
সামাজিক
সুরক্ষা প্রশ্নে ৮৫ শতাংশ নারী জানান, লকডাউনের সময় তারা কোনও অর্থনৈতিক
সহায়তা পাননি। ১০ শতাংশ স্থানীয় কমিশনারের কাছ থেকে কিছু অপর্যাপ্ত
খাদ্যসহায়তা পেয়েছেন। এদের মধ্যে একজন জানান, তাকে ৩০ দিনে মাত্র ২ কেজি
চাল দেয়া হয়েছিলো। এমনকি ক্ষুধা এড়ানোর জন্য প্রবীণ নারীরা বিকাল পর্যন্ত
ঘুমিয়ে কাটান- এমন চিত্রও রয়েছে বস্তিতে।
বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র
এই জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এগুলো দ্রুত
বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। এগুলো হলো- বস্তিতে বাস করা লোকদের
কাজ ফিরে না আসা পর্যন্ত জরুরি খাদ্যসহায়তা প্রদান, স্বাস্থ্যকর কিট
সরবরাহ, কোভিড-১৯ প্রতিরোধ এবং সুরক্ষা বিষয়ক জনসচেতনতা তৈরি, বিশেষ
স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং
তাদের জন্য নির্দিষ্ট বিচ্ছিন্নতা কেন্দ্র তৈরি করা। অর্থনৈতিকভাবে
ক্ষতিগ্রস্থ দরিদ্র নারী অভিবাসী- যারা বস্তিতে বাস করে তাদের জন্য সরকারের
বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নারী ও শিশুদের প্রতিসহিংসতা
হ্রাস করার কৌশল হিসেবে শান্তিপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্কের বিষয়ে বিশেষ
সচেতনতার সংগঠন করা এবং নারীর প্রতিসহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য আইনি
সহায়তা, পরামর্শ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করা। অভ্যন্তরীণ
অভিবাসী নারীদের জীবিকা নির্বাহের অতিপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অগ্রাধিকার
ভিত্তিতে নির্ধারণ করা। দরিদ্র মানুষের জীবিকা নির্বাহের বিকল্পকে আরও
শক্তিশালী করতে বস্তিবাসী নারী ও পুরুষদের ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করার জন্য
প্রয়োজনীয় মূলধন নিশ্চিত করা।
বিএনএসকে-এর নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া
ইসলাম বলেন, জরিপটি চালাতে গিয়ে বস্তিবাসী নারীদের জীবনযাপনের ভয়ঙ্কর চিত্র
ওঠে এসেছে। বিশেষ করে এই করোনাকালে তারা অমানবিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য সচেতনতার মারাত্মক অভাব রয়েছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯ পরিস্তিতিতে
স্বাস্থ্যবিধি মানছে না তারা। আর মানার উপায়ও নেই। যেখানে ৫ বাই ৬ ফুট
আয়তনের একটা রুমে ৫-৬ জনের পরিবার বাস করে সেখানে বিধি মানা সম্ভব নয়।
এছাড়া সাবান, স্যানিটাইজার, ফেস মাস্কসহ এ সংক্রান্ত সরঞ্জামের চরম সংকট
তাদের। যেখানে দু’বেলা খাবার জুটাতে পারছেন না, সেখানে এগুলো ম্যানেজ করা
কষ্টসাধ্য। তিনি জানান, বিএনএসকে ৫০০০ পরিবারের মাঝে এসব স্বাস্থ্য সরঞ্জাম
সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছে। সুমাইয়া ইসলাম বলেন, তারা ইতিমধ্যে ১০০০
পরিবারকে দু’মাসের খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে চাল-ডাল, পেঁয়াজ,
আলু, তেল, লবন, সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিন। তিনমাসে ৬ হাজার মানুষকে খাবার
দিয়েছেন সংস্থাটি। এ সহায়তা চলমান রয়েছে। সাহায্যপ্রাপ্তরা বেশিরভাগই
ডোমিস্টিক ওয়ার্কার। বস্তিবাসী অসুস্থ্য নারীরা যেনো সহজেই হাসপাতালগুলো
চিকিৎসাসেবা পান সে ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সুমাইয়া ইসলাম।