ঢাকা : দেশের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও মুদ্রণ হয়ে থাকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তত্ত্বাবধানে। প্রাথমিক ও মাদ্রাসার এবতেদায়ির বই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহ করা হয় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে। এতে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানই দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাগজ কিনে বই মুদ্রণ করে জেলা পর্যায়ে সরবরাহ করে থাকে। আর মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য বই ছাপা হয় স্থানীয় দরপত্রের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে এনসিটিবি নিজস্ব উদ্যোগে কাগজ কিনে দরপত্রের মাধ্যমে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করে। বিনামূল্যে পাঠ্যবই মুদ্রণের কাগজ কেনা নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বই ছাপার ক্ষেত্রে কয়েক বছর থেকে কাগজ উৎপাদনে নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ পরিমাণ কাগজ কেনার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ কাগজ কেনার জন্য যে প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়েছে সেটিরও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) অনুমোদন নেই। অনুমোদনহীন কাগজ বিক্রির জন্য বিএসটিআই মামলা করেছে এমন দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও কাগজ কেনা হচ্ছে। এ অবস্থায় অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানের মানহীন কাগজে পাঠ্য বই মুদ্রিত হলে দেশের মাধ্যমিক স্তরের প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থীর হাতে মানহীন বই যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি এখন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এবার মাধ্যমিক স্তরের ২৩ কোটি ৪৪ লাখ ৮২ হাজার পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য ২০ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন কাগজ কিনতে এনসিটিবি গত মার্চ মাসে টেন্ডার আহ্বান করে। ২০টি লটে ভাগ করা ১৬১ কোটি টাকার এই টেন্ডারে অংশ নেয় ১৪টি প্রতিষ্ঠান। তা থেকে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে কাগজ সরবরাহের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক পাঁচটি লটের কাগজ সরবরাহের জন্য নির্বাচিত হয়েছে গাজীপুর বোর্ড মিলস। প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এমনকি এনসিটিবির পরিদর্শন টিম সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েও প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সংযোগ বন্ধ পেয়েছে বলে জানা গেছে। এর পরও এই প্রতিষ্ঠানকে কাগজ সরবরাহের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। কাগজ উৎপাদনে সক্ষম নয় এমন প্রতিষ্ঠান কিভাবে কাগজ সরবরাহ করবে, আদৌ মানসম্পন্ন কাগজ সময়মতো সরবরাহ করতে পারবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এরপর চারটি লটের কাগজ সরবরাহের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে মেসার্স আল নূর পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডকে। প্রতিষ্ঠানটির বিএসটিআইয়ের কোনো অনুমোদন নেই বলে জানা গেছে। বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ গত ১৮ মে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে পৃথক তিনটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। ওই সব অভিযানে লেখা ও ছাপার কাগজের গুণগত মান যাচাই ছাড়া এবং বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স গ্রহণ না করে অবৈধভাবে বিএসটিআইয়ের মানচিহ্ন বা লোগো ব্যবহার করে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করে পণ্য বিক্রয় ও বিতরণ করায় আল নূরের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। একই দিন একই অভিযোগে একই আদালতে মামলা হয়েছে এ রকম আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো পূর্বাচল পেপার মিলস লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানও একটি লটের কাগজ সরবরাহের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
এনসিটিবির টেকনিক্যাল কমিটি কাগজ কেনার টেন্ডার মূল্যায়ন করে ৯টি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করে অতি সম্প্রতি অনুমোদনের জন্য ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এই প্রস্তাবে অনুমোদন দিলেই বিএসটিআইয়ের অনুমোদনহীন এবং কাগজ উৎপাদনে সক্ষম নয় এমন প্রতিষ্ঠান থেকে কাগজ ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে। এর পর এই মানহীন কাগজ দিয়েই ছাপা হবে দেশের মাধ্যমিক স্তরের প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থীর পাঠ্য বই। এমনিতেই চলতি বছরের প্রাথমিকের বইয়ের ছাপা যথাযথ মানসম্পন্ন হয়নি বলে আলোচনা হচ্ছে। আগামী বছরের মাধ্যমিকের বই মানহীন কাগজে ছাপা হলে প্রাথমিকের পর মাধ্যমিকের বই নিয়েই সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
বিএসটিআই মামলা করেছে এবং অনুমোদন নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে কাগজ সরবরাহের জন্য নির্বাচিত করা প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠানের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নেই কিংবা মামলা হয়েছে এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ এমনটি হলে খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। উৎপাদনে নেই এবং গ্যাস সংযোগ না থাকা প্রতিষ্ঠানকেও নির্বাচিত করা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, পরিদর্শন কমিটির ইতিবাচক রিপোর্টের ভিত্তিতেই তাদের নির্বাচিত করা হয়েছে।