মায়েরা সন্তান নিয়ে তার সাথে সেলফি তোলে। সবাই তাকে টোনি নামে ডাকে। হকারেরা তার হাতে উপহার হিসেবে ব্রেসলেট পড়িয়ে দেয়। চিত্রশিল্পীরা তার স্কেচ একে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে। টিভি চ্যানেলগুলো তার সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। আবার অনেকেই প্রশ্ন করেন, কে এই মারিয়া আন্তোনিয়েতা আলভা?

উত্তর হচ্ছে, তিনি পেরুর ৩৫ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস বিপর্যয়ের মধ্যে নিজদেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে তার নেয়া নানা পদক্ষেপ তাকে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসার পাত্রীতে পরিণত করেছে।
আলভা হারভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে জনপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করেছেন।

তার শিক্ষক ও হার্ভার্ডের অর্থনীতি বিষয়ক অধ্যাপক রিকার্দো হজম্যান বলেন, লাতিন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, পেরুর ম্যাক্রো অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিশ্চিতভাবেই সবার থেকে এগিয়ে আছে। তিনি বলেন, টোনি সেখানে না থাকলে এমন সফলতা কল্পনা করা অসম্ভব ছিল। উল্লেখ্য, বর্তমানে পেরুসহ আরো ১০টি দেশে অর্থনৈতিক পরামর্শ দেয়া বিশেষজ্ঞদের একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন হজম্যান।

আলভা পেরুর অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন গত অক্টোবরে। এর মধ্যেই দেশটির প্রেসিডেন্ট মার্টিন ভিজক্যারার মন্ত্রিপরিষদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেছেন তিনি। পেরুর রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। সন্ত্রস্ত জনগণকে সরকারি নীতিমালা বুঝিয়ে বলায় তার পরিচিতি রয়েছে।
আলভাকে নিয়ে পেরুর বিদায়ী অর্থমন্ত্রী কার্লোস অলিভা, তিনি যোগাযোগে খুবই ভালো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লাতিন আমেরিকায় ‘মিলেনিয়াল’ (১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে জন্ম নেয়া ব্যক্তি) অর্থমন্ত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ন্ত ওই দলের এক উজ্জ্বল সদস্য আলভা। তিনি সহ ওই দলের অন্যান্য অংশীদাররা হচ্ছেন, আর্জেন্টিনার মার্টিন গুজমান (৩৭), ডমিনিকান রিপাবলিকের হুয়ান আরিয়েল জিমেনেজ (৩৫) ও ইকুয়েডরের রিচার্ড মার্টিনেজ (৩৯)।

সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালার দায়িত্বে থাকা সহজ কাজ নয়। আলভা এই পুরো সংকট পারি দিতে পারবেন কিনা তাও এখনো নিশ্চিত নয়। কিছু অর্থনীতিবিদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরে পেরুর জিডিপি ১০ শতাংশ হ্রাস পাবে। কাজ হারাবেন হাজার হাজার মানুষ। তেমনটি হলে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর্থিক মন্দায় পড়বে দেশটি।

যা পদক্ষেপ নিলেন আলভা
দায়িত্বে আসার পর প্রাথমিকভাবে সরকারের অবকাঠামো পরিকল্পনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনেন আলভা। আঞ্চলিক ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়নে দ্রুত অর্থ খরচে সাহায্য করেন তিনি। এতে দেশটির ইতিহাসে সরকারি বিনিয়োগে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি দেখা গেছে। আলভা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে ঘাটতি কমিয়ে পেরুর প্রবৃদ্ধি বাড়াতে চেয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ২.২ শতাংশ।

এক দশকের মধ্যে এ হার সর্বনিম্ন।
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় বেশ আগেভাগেই লকডাউন জারি করেছিল পেরু। তা সত্ত্বেও ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব তীব্র আকার ধারণ করে দেশটিতে। আলভার তাৎক্ষণিকভাবে তার মনোযোগ ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের দিকে সরিয়ে নেন। পরিবার, ব্যবসার জন্য সহায়তা দেন। চলতি মাস থেকে অর্থনীতি ফের চালুতে জোর দেন।
আলভা পূর্বে জানিয়েছেন, ছোটবেলায় তার বাবার সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চল পরিদর্শনে যেতেন তিনি। সেসময় ওই অঞ্চলগুলোয় চরম দারিদ্র্য দেখেছেন তিনি। ওই দারিদ্র্য দূরীকরণে নিজেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন পেরুর অর্থমন্ত্রী।

পেরুতে নারীদের রাজনৈতিক অঙ্গনে সচরাচর দেখা যায় না। সেখানে আলভা এক ভিন্ন চিত্র স্থাপন করেছেন। নারী ক্ষমতায়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। আলভা সম্পর্কে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট অব পেরুভিয়ান স্টাডিজের প্রধান প্যাট্রিসিয়া জারাতে বলেন, তিনি সুদক্ষ কিন্তু আগ্রাসী নন। তিনি এটা তার কাজের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেন। এটা ভিন্ন ধরনের নারী ক্ষমতায়ন।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার নিয়োগের পরপর অনেকে সমালোচনা করেছিল যে, নিজের পিতার পরিচয়ে এই পদ পেয়েছেন তিনি, নিজের অভিজ্ঞতার জন্য নয়। সেসময় নিজের সমালোচনা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, এটা পৌরুষত্বের বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছুই নয়। আমি যদি একজন পুরুষ হতাম, তাহলে আমার নিয়োগ নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠতো না। প্রসঙ্গত, আলভার বাবা জর্জ আলভা পেরুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং (ইউনিভার্সিদাদ ন্যাসনাল দে ইঞ্জেনিয়েরিয়া)-এর রেক্টর ও একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।

পেরুর এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেন আলভা। এরপর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ২০১৪ সালে জনপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। গত দশকজুড়ে পেরু সরকারের নানা পরিকল্পনা, পরিকল্পনার ব্যাপ্তিসহ নানা কর্মসূচিতে জড়িত ছিলেন তিনি। এর মধ্যে দেশটির জাতীয় বাজেট তৈরিও রয়েছে।
আলভা অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার দুই মাসের মাথায় পেরু সরকারের সামনে হাজির হয় এক উভয় সংকট- লকডাউন জারি করে অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলা বা লকডাউন না জারি করে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি নেয়া। এমতাবস্থায় দেশে-বিদেশে মহামারি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে অর্থনীতি বাঁচাতে সমাধানের এক লম্বা তালিকা তৈরি করেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে নগদ অর্থ বিতরণ, ভর্তুকি দেয়া, সরকার-সমর্থিত ব্যবসাগুলোকে ঋণ দেয়া। এসব পদক্ষেপের কোনোটিই এর আগে পেরুতে কখনোই নেয়া হয়নি।
মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিসের বিশ্লেষক জেইমি রয়শে বলেন, সরকারের অভ্যন্তরে আলভার জোরাজোরির কারণেই পেরু এত গোছালো পদক্ষেপ নিতে পেরেছে।
এছাড়া, বিনিয়োগকারীদের আস্থা প্রদানে, দুই সপ্তাহ আগে আন্তর্জাতিক বাজারে রেকর্ড পরিমাণ কম দামে ৩০০ কোটি ডলারের বন্ড বিক্রি করেছে পেরু সরকার।

তবে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আলভার যাত্রাপথ একেবারে মসৃণ নয়। অনেকের কাছেই নগদ অর্থ পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে। লকডাউনে আয়হীন অবস্থায় খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাবে পড়েছেন অনেকে। ভাইরাসটির বিপর্যয় যত জটিল হচ্ছে, আলভার কাজও ততো কঠিন হচ্ছে। কাজ হারিয়ে রাজধানী লিমা ত্যাগ করছেন হাজারো মানুষ। গত ফেব্রুয়ারিতে পেরুর রাষ্ট্র-পরিচালিত তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান পেত্রোপেরুর তৎকালীন চেয়ারম্যান আলভাকে ‘বেকুব’ বলে পদত্যাগ করেন। আলভা প্রতিষ্ঠানটির জন্য ১৫০ কোটি ডলার অর্থায়নের অনুমোদন না দেয়ার পর তার ওই সমালোচনা করেন পেত্রোপেরুর সদ্য-বিদায়ী চেয়ারম্যান। এর কয়দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি দল ১৮টি হাইওয়েজুড়ে ব্যানার টাঙ্গিয়ে আলভার প্রতি সমর্থন জানায়।

‘আলভার পরিবার ত্রাণ প্যাকেজগুলো থেকে সুবিধা পাচ্ছেন’, এমন অভিযোগে গত সপ্তাহে পেরুর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার পদত্যাগের গুঞ্জন উঠে। আলভা সকল গুঞ্জন উড়িয়ে দিয়ে বলেন, তার আয়-ব্যয়ের হিসাব সকলের জন্য অনলাইনে উন্মুক্ত রয়েছে।
(ব্লুমবার্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সংক্ষেপিত অনুবাদ)

Share Now
January 2025
M T W T F S S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031