ঊষর মরুভূমিময় জর্ডান দেড় মাসেরও কম সময়ে এক্সট্রিম বা চরম মাত্রার লকডাউনে বৈশ্বিক মহামারি করোনা প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে । করোনা ঠেকাতে দেশটিতে ১৭ই মার্চ জরুরি অবস্থা এবং পরবর্তীতে জারি করা হয় কারফিউ। এতে বহু মানুষ অর্থ কষ্টে, বিশেষত: শ্রমজীবিরা কর্মহীন হওয়ায় খাদ্য সংকটে পড়ে যায়। যদিও পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারেরর তরফে জরুরি ভিত্তিতে ব্রেড এবং বেবিফুড বিতরণ করা হয়। সবার জন্য সুপেয় পানির সংস্থানও নিশ্চিত করা হয়। সরকারের কঠোর পদক্ষেপে জনগণের কষ্ট হলেও আজ গোটা দেশ আপাতত কোভিড-১৯ মুক্ত! ২৭ শে এপ্রিল পর্যন্ত সংখ্যার বিচারে নুন্যতম ছিল সংক্রমণ। ২৮ শে এপ্রিল একেবারে জিরোতে এসেছিল, অর্থাৎ এই দিনে জর্ডানে নতুন করে কারও শরীরে করোনার সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি বা কেউ শনাক্ত হয়নি। তবে পরবর্তী ৩ দিনে আরও ৮ জনের করোনা ধরা পড়েছে।
আম্মানে থাকা বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, দেশটিতে বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় সোয়া লাখ বাংলাদেশির বাস।
বেশির ভাগই নারী, প্রায় ৯০ ভাগ। জর্দান নদীর পূর্ব তীরের
ট্রান্সজর্ডান, আজকের স্বাধীন জর্ডানে বাংলাদেশিরা কাজ করছেন বছরের পর বছর
ধরে। দেশটির অন্তত ৩০টা শিল্প এলাকায় বাংলাদেশিরা তাদের কর্মগুণে রীতিমত
রাজত্ব করছেন। তারা মূলত কাজ করেন গার্মেন্টসে। স্রষ্টার কৃপা পুরো জর্ডানে
এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেনি।
তবে
জর্ডানে কড়া কারফিউ’র কারণে কয়েক হাজার বাংলাদেশি অর্থ ও খাদ্য সঙ্কটে
ছিলেন। তাদের যতটা সম্ভব সহায়তা দিয়েছে দূতাবাস। রাষ্ট্রদূত নাহিদা
সোবহানের দাবি- জর্ডান সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে (কারফিউর মধ্যেই) তারা
১৯টি স্পটে ৩৩০০ বাংলাদেশির মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন। এখনও তাদের বিতরণ
কার্য অব্যাহত রয়েছে।
নানা কারণে জর্ডান প্রথম
এদিকে
কূটনৈতিক এবং স্থানীয় বাংলাদেশ কমিউনিটি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে,
কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে নানা কারণে মধ্যপ্রাচ্যে জর্ডানই প্রথম। করোনাকালের
সূচনাতে প্রয়োজনীয় ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল দেশটি। ফলে সংক্রমণের হার
বাড়েনি। ১ লা মার্চ অবধি জর্ডানে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের আর মোট
আক্রান্ত ৪৫৯ জন। এমন সংখ্যায় প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র,
বৃটেন, ইতালির মত উন্নত দেশগুলোতে। করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষক
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাব মতে, জর্ডানে ৮০ ভাগ করোনা রোগী
সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছেন। অবশিষ্টরা অর্থাৎ আক্রান্ত ৮৯ জন এখনও
চিকিতসাধীন বা আইসোলেশনে রয়েছেন।
লকডাউন শিথিল হচ্ছে, তবে…
পরিস্থিতির উত্তরণে জর্ডানে ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল হচ্ছে। বিভিন্ন সেবা ও ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালুর অনুমতি দিচ্ছে সরকার। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং সুনির্দিষ্ট বিধি নিষেধসহ স্থানীয় গণ-পরিবহনও চালু হয়েছে ২৯ শে এপ্রিল থেকে। তবে শর্ত দেয়া হয়েছে পরিবহনগুলো তার সামর্থের সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ যাত্রী তারা বহন করতে পারবে। সকাল ৯টা থেকে বাস চলবে। জর্ডানের সমস্ত আইনসংস্থাকে তাদের কাজ পুরোদমে শুরুর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর্থিক নিরীক্ষক, ট্যাক্স, অ্যাকাউন্টিং পরামর্শ সংস্থা এবং বিভিন্ন আর্থিক লেনদেন পরিচালনাকারী সংস্থাকে তাদের কার্যক্রম চালু করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। দেশটির সব লন্ড্রি, এক্সেসরিস, ঘড়ি এবং জুতা মেরামতের দোকানগুলো খুলে দেয়া হচ্ছে। শপিংমলও খুলছে, তবে মলের গেমিং জোন, সিনেমা হল, থিয়েটার, ক্যাফে এবং রেস্তোঁরা এখনই চালু হচ্ছে না। যেসব প্রতিষ্ঠান চালুর অনুমতি পেয়েছে তাদের প্রত্যেককে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সুরক্ষামুলক ব্যবস্থা গ্রহণ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, গ্রাহকদের মধ্যে নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সারিবদ্ধভাবে সেবা গ্রহণ এবং জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, নতুন নির্দেশনার আলোকে জর্ডানের বাসিন্দারা পায়ে হেটে অথবা যানবাহনে সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত কিছু নির্দেশনা মেনে প্রায় স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছেন। তবে শুক্রবার পুরো ২৪ ঘণ্টা জর্ডানে কঠোর কারফিউ থাকবে। জনসাধারণ যেন জুমার নামাজ বা অন্য কোনোভাবে জামায়েত হতে না পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা। এছাড়া তারাবিহ নামাজের উপরও নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকছে। করোনা মোকাবিলায় জর্ডানের অবস্থান প্রসঙ্গে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাদ জাবের এক বার্তায় জানিয়েছেন- সামাজিক দূরত্ব নীতি এবং বিভিন্ন পরিষেবাসমূহ বন্ধ রাখার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিচারে জর্ডানের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া আগামী মাসগুলোর জন্য একটি সমন্বিত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিকল্পনা প্রণয়নে সরকার কাজ করছে।
শর্ত না মানলে কঠোর ব্যবস্থা
ওদিকে
জর্ডানের গণমাধ্যম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আমজাদ অ্যাডায়েলে নাগরিকদের সতর্ক
করে বলেছেন- কারফিউ শিথিল করার সরকারী সিদ্ধান্ত কার্যকর করার প্রক্রিয়ার
অনেক কিছুই জন সাধারণের দায়বদ্ধতার উপর সরাসরি নির্ভরশীল। এই সংক্রান্ত
আইনভঙ্গের ঘটনা বৃদ্ধি পেলে সরকার লকডাউনের মত কঠোর ব্যবস্থায় পুনরায় ফিরে
যেতে বাধ্য হবে। গত বুধবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত ২৩৬ গাড়িকে আইন লঙ্ঘনের
দায়ে আটক করা এবং তার চালকদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে
জানিয়ে তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে বা হচ্ছে তাদের প্রয়োজনীয়
সুরক্ষা, সাবধানতা অবলম্বন, মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায়
এবং যতটা সম্ভব কোনও কিছু স্পর্শ করা এড়ানোর মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণের স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তাছাড়া সংক্রমণ ঠেকানো বিষয়ক
নির্দেশনা লঙ্ঘনকারীদের জরিমানার বিধান রেখে একটি নতুন প্রতিরক্ষা আদেশ
জারির বিষয়ে বিবেচনা করছে সরকার। তথ্য বা গণমাধ্যম বিষয়ক জুনিয়র মন্ত্রী
আরও জানান করোনা নিয়ন্ত্রণে জর্ডানে যেটুকু সাফল্য এসেছে তা ধরে রাখার
বিষয়টি একান্তই জনগণের ওপর নির্ভর করছে।
উল্লেখ্য, করোনা পরিস্থিতি
স্বাভাবিক হয়ে আসায় জর্ডানের বাদশাহ’র জারিকৃত নির্দেশনার আলোকে বিদেশে
অবস্থান করা দেশটির শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম ৫ই মে শুরু হচ্ছে।
প্রথম দফায় ৩ হাজার ৯৯ শিক্ষার্থীকে দেশে ফেরানো হবে।
বিশ্লেষকের মূল্যায়নে জর্ডান সরকারের সাফল্য
জর্ডান টাইমস-এর প্রখ্যাত কলামিস্ট খালিফ আলখাওয়ালদাহ যে কোন দেশে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে করোনার সংক্রমণ কমিয়ে আনার সাফল্যের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টকে চিহ্নিত করেছেন। সংকটটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মোকাবেলা করা, সামরিক ব্যবস্থাপনা, সঠিক সুরক্ষা নির্দেশনা, সরকারী ও বেসরকারী সমন্বিত অংশগ্রহণ, মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটিসহ বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীল ভুমিকা, জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি বজায় রেখে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়াই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি বলে মনে করেন তিনি। সত্যিকার অর্থে জর্ডানের সাফল্যের নেপথ্যে এ সব কারণ বা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল বা আছে বলে মনে করেন ওই বিশ্লেষক। জর্ডান সরকারের করোনা ভাইরাস সঙ্কট মোকাবিলার সামগ্রিক সাফল্যকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া অসামান্য এবং নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে জর্ডান তার প্রতিটি সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ধারণ ও তা মোকাবেলায় একটি সুসমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছে, যা সংকট উত্তরণে একটি দুর্দান্ত সাফল্য বা মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে অন্তত মধ্যপ্রাচ্যে।