হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে।খুলতেই দেখা গেলো শুকনো বিবর্ণ চেহারার এক কিশোর। চোখ দুটি যেনো গর্তে ঢুকে গেছে। বলছিলো, ‘সকাল থেকে পানি ছাড়া কিচ্ছু খাইনি। বাসায় খাবার নেই। পাঁচটা টাকা হবে।’ পাঁচ টাকা দিয়ে কী খাবার খাবে? কিশোর জানালো এ পর্যন্ত বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ৪০ টাকা পেয়েছি। খাবারের জন্য মধ্য বাড্ডা থেকে পায়ে হেঁটে রামপুরার উলন পর্যন্ত আসে এই কিশোর।
ক্ষুধার্ত কিশোর জানায়, তার বাবা একটি শপিংমলে কাপড়ের দোকানে চাকরি করেন।
লকডাউনের পর জমানো টাকা ও মালিকের কাছ থেকে ধার নিয়ে চলেছেন। সপ্তাহ হিসেবে বেতনের টাকা আনার কারণে মালিকের কাছেও কোনো পাওনা নেই। তাই চলতি মাসে চরম বিপর্যয়ে পড়েছে তাদের চার সদ্যেসের পরিবার। কিশোর কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, ‘এইভাবে আমরা কিভাবে বাঁচবো, আমাদের কী হবে?’
একই অবস্থা আক্কাসের। মালিক বারবার তাড়া দিচ্ছেন। এক দিন, দু’দিন করে সময় নিচ্ছিলেন আক্কাস। এপ্রিল মাস প্রায় চলে যাচ্ছে। কিন্তু বাসা ভাড়া দেয়া হয়নি। স্ত্রী, সন্তানের মুখের দিকে তাকানো যায় না। খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। অন্যের দেয়া খাদ্য সামগ্রী নিতে হচ্ছে। নিজেকে এতোটা অসহায় এই জীবনে কখনও মনে হয়নি। স্ত্রী, মা ও দুই সন্তান নিয়ে খিলগাঁও এলাকায় থাকেন আক্কাস। গুলিস্তানের সিটি প্লাজায় দর্জি ঘরের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন তিনি।
অসহায়ের মতো বারবার প্রতিষ্ঠানের মালিককে কল দিচ্ছিলেন। কাঁদছিলেন। বলছিলেন বাসা ভাড়ার জন্য ঘরের মালিকের চাপ। ভৎসনার কথা। বাসায় মাছ, মাংস, ডিম নেই অনেক দিন যাবত। ছোট্ট মেয়েটা কান্না করছে। সন্তানদের খাবার জুটাতে গিয়ে গত রাতে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই না খেয়ে আছেন। মিথ্যা করে বলেছেন পরে খাবেন- পরেও আর খাননি। কারণ খাবারই ছিলো না। এভাবে প্রতিদিন কর্মচারীদের কষ্টের কথা শুনেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। কিন্তু তেমন কিছু করার নেই। অসহায়ের মতো শুধু শুনেন। আক্কাসের মতো একই অবস্থা ঢাকা শহরের লক্ষাধিক কর্মচারীর। তারা তৈরি পোশাক বিক্রির বিভিন্ন দোকানে ও কারখানায় কর্মরত।
প্রাণঘাতী করোনা প্রতিরোধের লড়াইয়ের এই লকডাউনে কর্মচারীরা খাদ্য-অর্থ সঙ্কটে। এসব বিষয়ে কথা হয়েছে মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে। মালিকরা জানান, এই অবস্থায় তারাও ভালো নেই। তাই কর্মচারীদের দুর্দিনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না।
সন্ধ্যার পর মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকার ফুটপাতে মাথা নিচু করে বসেছিলেন এক যুবক। বারবার হাত দিয়ে চোখ মুছছিলেন। খানিকটা দূর থেকে মনে হলো তিনি কান্না করছেন। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে অসহায়ের মতো নির্বাক তাকিয়ে থাকেন। এক পর্যাযে জানান, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের একটি দোকানে চাকরি করেন। গত মাসের বেতনের টাকা গত মাসেই এনেছেন। প্রতি সপ্তাহে মালিকের কাছ থেকে টাকা নিতেন। দোকান বন্ধ হওয়ার পর থেকে ধার দেনা করে চলছেন। কিছু দিন যাবত কোথাও ধারও পাচ্ছেন না। বাসায় খাবার নেই। স্ত্রী আর এক সন্তান খাবারের অপেক্ষায় আছে।
বেলা ২টার পর বের হয়ে নানা জায়গা ঘুরেছেন খাবার পাননি কোথাও। কিভাবে শূন্য হাতে বাসায় ফিরবেন। সন্তানকে কি খেতে দিবেন। বলতে বলতে শব্দ করে কাঁদতে থাকেন এই যুবক। তারপর উলন এলাকার এক ব্যবসায়ী তাকে চাল, ডাল দিয়ে সহযোগিতা করেন। কর্মচারীরা অসহায় হয়ে বারবার প্রতিষ্ঠানের মালিকের সহযোগিতা চেয়েও পাচ্ছেন না।
সিটি প্লাাজার দর্জি ঘরের মালিক রাকিবুল হাসান জানান, কারখানা ও দোকান মিলিয়ে তার প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ জন কর্মচারী। যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা হচ্ছে। কিন্তু এভাবে চললে এপ্রিলের বেতনও দেয়া সম্ভব হবে না বলে জানান তিনি। এই ব্যবসায়ী জানান, ব্যবসা বন্ধ। রমজান উপলক্ষে কারখানায় কোটি টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে করোনা পরিস্থিতির আগেই। এখন হাতে কোনো টাকা নেই। রমজান উপলক্ষে তার সিদ্দিক বাজারের কারখানায় প্রায় দেড় কোটি টাকার পাঞ্জাবি তৈরির কাজ চলছিলো। এরমধ্যেই সব বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা মহানগর রেডিমেইড গার্মেন্টস মালিক সমবায় সমিতির সদস্য সহস্রাধিক। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব কারখানা। মূলত তারা পোশাক তৈরি ও পাইকারি বিক্রি করেন। সমিতির সদস্য ছাড়াও হাজার হাজার ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের প্রতিষ্ঠানে বিপুল মানুষ কর্মরত।
ঢাকা মহানগর রেডিমেইড গার্মেন্টস মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহসিন হোসেন জানান, কর্মচারীরদের বেতন সাধারণত ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া, খাবার খরচ শেষে মাস শেষে তাদের টাকা থাকে না। করোনা প্রতিরোধের এই লকডাউনে তারা প্রচণ্ড দুর্ভোগে রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি অসহায় এসব মানুষের পাশে দাঁড়াতে।