৬০০০ বছরের মেসোপটেমিয় সভ্যতার ধারক ওই ভূখন্ডে যুগে যুগে যত বারুদ পুড়েছে তাতে ওই মাটি আর মাটি নেই, তা বারুদে পরিণত হয়েছে বহু আগেই মধ্যযুগ থেকে আজ অবধি ইরাক জ্বলছে। । কারবালার রক্ত স্নানকে তো ইতিহাস বেত্তারা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করেন। দুনিয়ার দেশে দেশে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন বছরান্তে ১০ই মহরম ইরাকের ফুরাত নদী তীরবর্তী ঈমাম হোসাইনের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে আজও চোখের পানি ফেলেন। প্রাচীনতম বহু সভ্যতার পীঠস্থান ইরাকে করোনা আঘাত আনে আজ থেকে পাক্কা দু’মাস আগে (২৪ শে ফ্রেব্রুয়ারি)। ৬০ দিন ধরে তাণ্ডব চালাচ্ছে। এই সময়ে ১৬ শ ৭৭ জনকে কাবু করেছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৮৩ জন।
বৃহস্পতিবার অবধি সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১১ শ ৭১ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, যুগের পর যুগ ধরে বারুদে তপ্ত ইরাকে সময়ের ব্যবধানে করোনা
বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। সপ্তাহ খানেক আগেও বহু মানুষের প্রাণ কেড়েছে ওই
মরণব্যাধি। কিন্তু এই ক’দিনে ততটা ক্ষিপ্র নয় তার গতি। ৩ দিনে দেশটিতে
করোনায় কারও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। বাড়ছে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার সংখ্যা। বলা
হচ্ছে দুনিয়ার দেশে দেশে যখন কোভিড-১৯ এর তাণ্ডবলীলার গতি ক্রমশ বাড়ছে, তখন
উত্তপ্ত ওই ভূখন্ড থেকে করোনা না-কি পালানোর রাস্তা খূঁজছে!
আরও আশার
দিক হচ্ছে, দেশটিতে দু’লাখের বেশি বাংলাদেশির বাস। অবিশ্বাস্য হলেও দূতাবাস
এবং বাংলাদেশ কমিউনিটি বলছে, করোনা না-কি এখনও একজন বাংলাদেশিকে ছুঁতে
পারেনি। অবশ্য বাংলাদেশিরা শুরু থেকেই দেশটির সরকারের কঠোর অনুশাসন মেনে
চলেছেন। দূতাবাসও তাদের এটি মানতে উতসাহিত করেছে। সব মিলে স্রষ্টার কৃপায়
বাংলাদেশি কেউ আক্রান্ত হননি বা কারও করোনা শনাক্তের খবর মিলেনি।
উদ্ভূত
পরিস্থিতে আসন্ন রমযান অর্থাৎ ঈদ অবধি ‘কড়া কারফিউ’ কিছুটা শিথিল করতে
যাচ্ছে ইরাক। রমযান মাসজুড়ে দিনে সীমিত সংখ্যক দোকান, মার্কেট খোলা থাকবে।
তবে স্টাফ ২৫ পারসেন্টের বেশি রাখা যাবে না। সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যে দোকান
বন্ধ করতে হবে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে এ রিপোর্ট লেখার মুহুর্তে রয়টার্স জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে ২০ হাজার সাধারণ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইরাকের সুপ্রিম জুডিশিয়ারি।
ইরাকের সঙ্কট করোনার চেয়েও ভয়াবহ
প্রাণঘাতি মহামারি করোনা আঘাত হানার অল্প ক’দিন আগেও ইরাকে গোলা বারুদ পড়েছে, পুড়েছে। নব্বইর দশকে কুয়েতে ইরাকি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে বাগদাদ যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা থেকে উত্তরণ যে কবে হবে, আদৌ হবে কি-না, তা নিয়ে আগাগোড়ায় সংশয় রয়েছে। সেই থেকে বাদগাদকে ঘিরে নানা ঘটনা। বহু অভিযান (অপারেশন ডেজার্ট স্ট্রম, সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের যৌথ অপারেশন, অপারেশন রেড ডন) এবং সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হয়েছে। ক্ষমতাধর সাদ্দাম হোসেনের সময়কাল এবং পরবর্তীতে টন টন গোলাবারুদ পড়েছে ওই ভুখন্ডে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র আর ইরান তো মূখোমুখিই। তেহরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সমরবিদের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে সেদিনও পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ দুটি দেশের রণপ্রস্তুতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে দামামা বেজেছিল তাতে চূড়ান্ত বিচারে ইরাকই পুড়তো। জঙ্গী আল কায়েদা, আইএসসহ নানা গোষ্ঠীর উতপাত, পরাশক্তি সমর্থনপুষ্ট বিদ্রোহী গেরিলাদের তাণ্ডব আর বিচ্ছিন্নতাবাদ সমস্যা তো আছেই। সব মিলে উতপ্ত ইরাকে শান্তির সুবাতাস কবে যে বইবে। বলা হচ্ছে ইরাকের সঙ্কট না-কী করোনার চেয়েও ভয়াবহ!
বেশ গতি নিয়েই আঘাত করেছিল করোনা
ইরাকে বেশ গতি নিয়েই আঘাত করেছিল বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালানো করোনা। প্রথম আগ্রাসন চালায় দেশটির নাজাফ প্রদেশে। দিনটি ছিল ২৪ শে ফেব্রুয়ারি। মুহুর্তেই আক্রমণ চালায় অন্য প্রদেশে। সংক্রমিত হতে থাকেন দেশটির অনেক নাগরিক। তখন প্রতিবেশি ইরান ও তুরস্কে করোনার ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাকের প্রশাসন উদ্যোগী হয়। দেশটির বড় শহরগুলোতে চটজলদি কমিয়ে দেয়া হয় অফিসের সময়, বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুল-কলেজ সিনেমা এবং ক্যাফে-রেস্তোরাঁর মতো জনসমাগমের স্থানগুলো। নামাজের জামাতেও সরকারের তরফে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু সরকারের আগাম এসব পদক্ষেপে ভেতরে বাইরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। ইরাকের প্রভাবশালী শিয়া নেতা মুক্তাদা আল-সদর রীতিমত বিদ্রোহ করে বসেন। তিনি করোনা ছড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। সরকারি সিদ্ধান্ত চ্যালঞ্জ করে জামাতে নামাজ অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দেন। অবশ্য শিয়া ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের কড়া অবস্থানে তা ধোপে টিকেনি। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে থাকে সরকার। দেশী-বিদেশী সকল নাগরিকের চলাফেরায় বিধি-নিষেধ আরোপ ও নির্দেশনা প্রদান করা ছাড়াও ইরাকের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়। অন্য দেশের সঙ্গে আকাশ, সড়ক ও নৌ যোগাযোগও পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু তাতেও থামানো যাচ্ছিলো না। এ অবস্থায় কুর্দিস্তানসহ কিছুকিছু প্রদেশে লকডাউন ও কারফিউ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে (গত ১৭ মার্চ) পুরো ইরাকে কারফিউ জারি করা হয়। যা কায়েক দফা বৃদ্ধির পর এখনও বলবৎ রয়েছে। বর্তমানে ঔষধ ও জরুরী সেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচলের উপরও কড়াকড়ি।
দূতাবাস যা করেছে,
সঙ্কটের সূচনা থেকে দূতাবাস প্রতিনিয়ত ইরাক প্রবাসী বাংলাদেশীদের স্বাগতিক দেশের আইন-কানুন, বিধি-নিষেধ ও নির্দেশনা মেনে চলতে এবং স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণ করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম ও ফোনালাপের মাধ্যমে সতর্কতা অবলম্বন করার অনুরোধ করে যাচ্ছে। মিশন কর্তৃক এ বিষয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। রাষ্ট্রদূত আবু মাকসুদ এম ফরহাদ স্বাক্ষরিত বার্তায় জরুরী প্রয়োজনে দূতাবাসের ৩টি হটলাইন নম্বরে যোগাযোগের জন্য বিপাকে পড়া বাংলাদেশী কর্মীদের অনুরোধ করা হয়। দূতালয় প্রধান অহিদুজ্জামান লিটন জানিয়েছেন, করোনার কারণে অনেকে কর্মহীন, তবে বেশ বিপাকে থাকা প্রায় ১৫০০ বাংলাদেশিকে দূতাবাস নগদ এবং খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কমিউনিটি বিশেষত বার্জানি ফাউন্ডেশন এবং আইওএম এর মাধ্যমে আরও কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে সহায়তা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তার মতে, করোনাকালে নয়, বাংলাদেশি কর্মীরা ব্যাপকহারে চাকরিহারা হবেন করোনা পরবর্তী সময়ে। তখনকার নানামুখি সঙ্কটের আশঙ্কায় দূতাবাস চিন্তিত। আর এ জন্যই দূতাবাস পরিস্থিতি সামলে নিতে এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে চায়।