rent_120172

ঢাকা : দুজন যুবক বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছেন। কিন্তু বাড়ির মালিক ব্যাচেলরকে ভাড়া দেবেন না। ‘ছয় মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স (অগ্রিম) করব’- একজনের কাছ থেকে এমন প্রস্তাব পাওয়ার পর আর  কোনো যাচাই-বাছাই না করেই বাড়ির মালিক তাদের ভাড়া দিয়ে দিলেন।

কদিন পরের কথা। বাড়ির নিচে বসে আছেন মালিক। দুটি ছবি দেখিয়ে পুলিশ তার কাছে জানতে চায়, তারা কোথায় আছে। দেখিয়ে দেয়ার পর দুতলায় ভাড়াটের ঘরে হানা দেয় পুলিশ। এরপর অস্ত্রসহ আটক হয় দুই যুবক। সঙ্গে বাড়িওয়ালার মেয়েকেও ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ওই দুই অস্ত্রধারীর একজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিল মেয়েটি।

এটি কোনো সত্য ঘটনা নয়, দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রায় প্রতিদিন সম্প্রচার করা একটি সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন। গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর থেকে টেলিভিশনে পুলিশের যে কয়টি বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে, তার একটি এটি। বাড়ি ভাড়া নিতে আগ্রহীদের বিষয়ে খোঁজ-খবর না নিয়ে কেউ যাতে ভাড়া না দেন- বাড়ির মালিকদের উদ্দেশে সেই বার্তা প্রচার করছে পুলিশ।

এই বিজ্ঞাপনটি নতুন নয়। কিন্তু গত তিন বছরেও বাড়ির মালিকদের কতটা সচেতন করতে পেরেছে বিজ্ঞাপনটি?

সাম্প্রতিক দুটি আলোচিত ও নির্মম জঙ্গি হামলার পর জানা গেছে, হামলাকারী জঙ্গিদের সবাই নিজেদের পরিচয় গোপন করে রাজধানী বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। নিয়ম থাকার পরও বাড়ির মালিকরা ভাড়া দেয়ার আগে ভাড়াটেদের জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্য কোনো নথি জমা নেননি, স্থানীয় থানাকে ভাড়াটেদের বিষয়ে কিছু জানাননি। অথচ ভাড়াটেদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে কয়েক বছর ধরে প্রচার চালাচ্ছে পুলিশ। ভাড়াটেদের এসব তথ্য জমা দেয়া বাধ্যতামূলকও করা হয়েছে পরে।

পুলিশ জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারীরা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বসুন্ধরা এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। এই হামলায় জড়িতদের একজন নিবরাস ইসলাম ঝিনাইদহ শহরে চলতি বছরের শুরুর দিকে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল সাঈদ পরিচয়। তার সঙ্গে সেখানে থাকতেন আরও সাত সহযোগী। চার মাস এই মিথ্যা পরিচয়েই নিবরাস স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে মিশেছে, তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করেছে।

এদিকে, এ ঘটনায় জড়িতদের বাড়ি ভাড়া দেয়ার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ-সাউথের ভারপ্রাপ্ত প্রো-ভিসিসহ তিনজনকে আটক করেছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একটি দল।

শনিবার বিকালে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়।

আটকরা হলেন নর্থ-সাউথের ভারপ্রাপ্ত প্রো-ভিসি গিয়াসউদ্দীন আহসান, তার ভাগ্নে আলম চৌধুরী ও ভবনের ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান তুহিন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি জানান, প্রো-ভিসি গিয়াসউদ্দীন আহসান এই হামলাকারীদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন। এই ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের তথ্য নিজ হেফাজতে রাখা বা সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেননি তিনি। বাড়ি ভাড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তাদের আটক করা হয়েছে।

আর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতে হামলার পরিকল্পনা নিয়ে যাওয়া পাঁচ যুবকও স্থানীয় একটি কলেজের ছাত্র পরিচয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল শোলাকিয়ার পাশের একটি আবাসিক এলাকায়।

দুই জঙ্গি হামলার ঘটনার পর দুটি বাড়ির মালিককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়েছিল। পরে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়। আর গুলশানে ভাড়া করা বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এখনো আটক আছেন।

জঙ্গিদের পরিচয় না জেনেই ভাড়া দেন বাড়ির মালিকরা

হলি আর্টিজানে হামলার প্রায় এক মাস আগে ২০ হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় বসুন্ধরা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় পাঁচ জঙ্গি। যে বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল তার মালিক থাকে বিদেশে। একজন তত্ত্বাবধায়ক বাড়ির দেখাশোনা করে। তার কাছ থেকেই নিবরাস ইসলাম ভুল তথ্য দিয়ে বাড়িটি ভাড়া নেয়। ওই বাড়ির কেয়ারটেকারকে আটক করেছে পুলিশ।

শোলাকিয়া হামলার সাত দিন আগে শহরের নীলগঞ্জ সড়কে বাড়ি ভাড়া নেয় চার জঙ্গি। বাড়ির মালিক আবদুস সাত্তারের কাছে তারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছিল স্থানীয় গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র বলে। ঈদের পর পরিচয়পত্র দেয়ার আশ্বাসও দেয় তারা। আর সরল বিশ্বাসে কিছু না দেখেই তাদের বাড়িতে তোলেন সাত্তার।

হামলার পর পুলিশ সাত্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। তবে কয়েক ঘণ্টা পর ছাড়া পান তিনি।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক মোরশেদ জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, বাড়ির মালিকদের যে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে, সেই নির্দেশনা মানা হয়েছিল কি না সে ব্যাপারে যাচাই-বাছাই চলছে।

ঝিনাইদহেও  ভুল তথ্য দিয়ে বাসা ভাড়া নেয় গুলশানে হামলাকারীদের একজন নিবরাস।  গত জানুয়ারি থেকে শহরের হামদহ সোনালী পাড়ায় সাবেক এক সেনাসদস্য কওছার আলীর বাড়িতে চার মাস থাকে নিবরাস। বাড়ির মালিকের কাছে নিজের পরিচয় দেয় ‘সাঈদ’ হিসেবে। তার সঙ্গে থাকত আরও সাতজন।

বাড়ির মালিকের স্ত্রী বিলকিস নাহার জানান, পাশের জামে মসজিদের ইমাম ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোকনুজ্জামান চার মাস আগে ভাড়াটে নিয়ে আসেন। রোকনুজ্জামান তখন বলেছিলেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র থাকবে। কথাবার্তা চূড়ান্ত হলে প্রথমে দুজন বাসায় ওঠে। কিছুদিন পর আরও ছয়জন আসে।

গুলশান হামলার পর স্থানীয়রা জানতে পারে তাদের পরিচিত সাঈদ খুনিদের একজন। এই ঘটনার পর নিবরাসকে ভাড়া নিতে সহায়তা করা রোকনুজ্জামানসহ কয়েকজনকে আটক করে র‌্যাব। বাড়ির মালিকের স্ত্রীকেও ধরে নেয়া হয়। তবে কয়েক ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদের পর ছাড়া পান তিনি।

বারবার তাগিদ দিয়েছে পুলিশ

গত বছরের ১৪ অক্টোবর ঢাকা রেঞ্জের অপরাধবিষয়ক সভায় আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ভাড়াটিয়াদের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য জেলার পুলিশ সুপারদের তাগিদ দেন। বিশেষ করে যেসব বাড়িতে ব্যাচেলর বা মেস ভাড়া দেয়া হয় সেগুলোর তথ্য অবশ্যই সংগ্রহ করার নির্দেশ দেন। ওই সময় তিনি বাড়ি ভাড়া দেয়ার আগে ভাড়াটিয়ার নাম, ঠিকানা, ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় তথ্য সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে দেয়ার জন্য বাড়ির মালিকদের অনুরোধ করেন। একই সঙ্গে থানা পুলিশকে ওই সব তথ্য যাচাই করার নির্দেশ দেন যাতে কোনো জঙ্গি বা দাগি সন্ত্রাসী বাড়ি ভাড়া নিয়ে অপরাধমূলক কর্মকা- ঘটাতে না পারে।

গত বছরের নভেম্বরের দিকে ঢাকা মহানগরের বাসিন্দাদের তথ্য সংগ্রহে মাঠে নামে পুলিশ। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটেদের ১৫ ধরনের তথ্য জমা দিতে হয় স্থানীয় থানায়। পুলিশ বলছে, গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় বাড়ির মালিকরা সচেতন থাকলে জঙ্গিরা নির্বিঘ্নে অপরাধ করতে পারত না।

আসামি হতে পারে বাড়ির মালিকও

পুলিশ বলছে, বাড়ি বা ঘর ব্যবহার করে কোনো আসামি অপরাধ করলে ফৌজদারি দ-বিধির ৩৪ ও ১২৯ ধারায় বাড়ির মালিককে সহযোগী হিসেবে আসামি করা যায়। এ ছাড়া ২০১২ সালে সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৭ ধারা অনুযায়ীও বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক অপরাধী সাব্যস্ত হতে পারে। এ আইনে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে।

Share Now
December 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
3031