করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের শুরুতে বেড়ে যাওয়া চালের দাম আবারও বেড়েছে। থামছে না চালের দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা।গরিবের মোটা চাল প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা দরে। চালের এই দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুধু ঢাকার খুচরা বাজারেই সীমাবদ্ধ নয়। কোনো কারণ ছাড়াই অভিজাত এলাকার সুপার শপগুলোতেও বাড়ানো হয়েছে চালের দাম। চালের এই দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এমনিতে লকডাউনের কারণে কাজ নেই। হাতে টাকা নেই।
এ অবস্থায় চালের বাড়তি দামে অনেকটা নাভিশ্বাস অবস্থা এসব মানুষের।
সূত্র
জানায়, করোনার অজুহাত সামনে রেখে মিলাররা গত এক মাসে মিল পর্যায়েই প্রতি
বস্তা (৫০ কেজি) চালে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়েছেন।এর প্রভাব
পড়েছে রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে। ফলে করোনার এই ক্রান্তিকালে চাল
কিনতে দিশেহারা সাধারণ ভোক্তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা ঠেকাতে
সামাজিক দূরত্ববিধি মানতে গিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে
এমনিতেই টাকা নেই। তার ওপর বাড়তি দামে চাল কিনতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে কেজিতে
চালের দাম বেড়েছে ৮ টাকা এবং মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১২ টাকা পর্যন্ত।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে চালের
দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ৭ শতাংশ এবং মাসের ব্যবধানে প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা
বলছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে আগের মতো পণ্য সরবরাহ হচ্ছে না। জরুরি
প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে মানুষকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। ফলে চাহিদার তুলনায়
সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে চালের দাম বেড়েছে। এছাড়া চিকন চালের মৌসুম
একেবারে শেষ। তাই সরবরাহও শেষ। ইতিমধ্যে নতুন বোরো ওঠা শুরু করেছে। এসব চাল
বাজারে এলে আশা করা যায় দাম কমবে।
একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী
পরিকল্পিতভাবে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকেই। দাম
নিয়ন্ত্রণে চালের বাজারে দ্রুত র্যাব ও ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান চালানোর
দাবি জানিয়েছেন ভোক্তারা।
রাজধানীর চালের আড়ত কাওরান বাজারের পাইকারি
চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এক মাস আগে মাত্র ৩৪
টাকায় এক কেজি মোটা চাল পাওয়া যেতো। আর এখন সেই মোটা চাল প্রতিকেজি ৫০ টাকা
দরে বিক্রি হচ্ছে, যা দুই সপ্তাহ আগে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। নাজিরশাইল চাল
বিক্রি হয়েছে ৬৮-৭০ টাকা, যা আগের সপ্তাহে ছিল ৬৫-৬৮ টাকা। করোনা ভাইরাস
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার আগে ছিল ৫২-৫৬ টাকা কেজি। মিনিকেট চাল কেজিপ্রতি বিক্রি
হয়েছে ৫৫-৫৮ টাকা, যা আগের সপ্তাহে ছিল ৫৪-৫৬ টাকা। বর্তমানে মাঝারি মানের
চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২-৬০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকার
মধ্যে। এক মাস আগে ছিল ৪৫-৫০ টাকার মধ্যে।
টিসিবি’র হিসাবেই বলা
হচ্ছে, গত এক মাসে মোটা চালের দাম বেড়েছে ২১.৬২ শতাংশ। শুধু মোটা চাল নয়,
গত এক মাসে সরু চালের দামও বেড়েছে ৮ শতাংশ। একইভাবে এই এক মাসের ব্যবধানে
ময়দার (খোলা) দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ।
রাজধানীর শাহজাহানপুর, মালিবাগ
বাজার, কারওয়ানবাজার, বাদামতলী বাজার, সূত্রাপুর বাজার, শ্যাম বাজার,
কচুক্ষেত বাজার, মৌলভী বাজার, মহাখালী বাজার, উত্তরা আজমপুর বাজার,
রহমতগঞ্জ বাজার, রামপুরা এবং মিরপুর-১ নম্বর বাজারের পণ্যের দামের তথ্য
নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে টিসিবি।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে
নাজির ও মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ
আগে ছিল ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে এ দুই ধরনের চালের দাম
বেড়েছে ৬.৬৭ শতাংশ। চিকন চালের পাশাপাশি দাম বেড়েছে মাঝারি মানের চালের।
টিসিবির হিসেবে, মাঝারি মানের চাল পাইজাম ও লতার দাম সপ্তাহের ব্যবধানে
বেড়েছে ২.৮৬ শতাংশ। বর্তমানে পাইজাম ও লতা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে
৫৮ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ভালো ব্র্যান্ডের চাল এখন
বাজারে পাওয়াই যাচ্ছে না।
চাল ব্যবসায়ীরা জানান, করোনা ভাইরাস আতঙ্ক
ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দাম বেড়ে যায়। এরপর র্যাব একের পর এক অভিযান
পরিচালনা করলে কিছুটা স্থির হয় চালের দাম। প্রায় এক মাস চালের দাম স্থির
থাকে। তবে এক সপ্তাহ ধরে আবার দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
বাজারে চাল কিনতে
আসা নাইমুল ইসলাম বলেন, আমাদের পরিবারে চারজন সদস্য। মার্চের শুরুতে ২৫
কেজির এক বস্তা চাল কিনেছিলাম। সেই চাল শেষ হয়েছে। তাই চাল কিনতে এসেছি।
আগে যে চালের বস্তা ১৩০০ টাকায় কিনেছি, এখন সেই চাল ১৬০০ টাকা চাচ্ছে। ২৫
কেজি চালের দাম এক মাসে ৩০০ টাকা বেড়েছে। এটা কীভাবে স্বাভাবিক হয়? এদিকে
করোনা আতঙ্ক কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, অন্যদিকে পণ্যের দাম ভোগাচ্ছে। কি ধরনের
মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছি বলে বোঝাতে পারবো না।
উত্তর বাড্ডার
বাসিন্দা নিয়াজ বলেন, মানবিক বিবেচনায় এখন চাল-ডালের দাম কম হওয়ার কথা।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আতঙ্কের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দাম। একশ্রেণির
ব্যবসায়ী যে পরিকল্পিতভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এই
ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত র্যাবের অভিযানে নামা উচিত। র্যাব অভিযানে না
নামলে দাম আরো বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এর আগে করোনার শুরুতেও চালের দাম
বাড়ে। এরপর র্যাব অভিযানে নামলে দাম বাড়া বন্ধ হয়। এখন র্যাবের অভিযান
নেই, সেই সুযোগ আবার ওই ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ানো শুরু করেছে।
একটি
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নোমান বলেন, কিছুদিন পরই বাজারে নতুন চাল
আসবে। এ মুহূর্তে চালের দাম বাড়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। কারসাজি চক্র
পরিকল্পিতভাবে চালের দাম বাড়াচ্ছে। এই চক্রই দেখবেন কিছুদিন পরে কম দামে
কৃষকের ধান কিনবে। কৃষক ধানের দাম পাবে না। অথচ এই চক্র ঠিকই চালের দাম
বাড়িয়ে মুনাফা হাতিয়ে নেবে। চাল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ত্রাণ দিতে
অনেকে মোটা চাল কিনছেন। এ কারণে বাজারে মোটা চালের চাহিদা বেড়েছে। ফলে গত
সপ্তাহেই বেড়েছে দাম। তবে গত সপ্তাহে চিকন চালের দাম কিছুটা কমছিল। কিন্তু
এখন আবার বেড়েছে।
কাওরান বাজারের পাইকারি আড়ত আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মিলারদের কারসাজি থামছে না। তারা সব ধরনের চালের দামই বাড়াচ্ছেন। তারা বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে চালের দাম বাড়াচ্ছেন। প্রথম অজুহাত ধানের দর বাড়তি। দ্বিতীয় অজুহাত বৈশাখে নতুন চাল এলে সব ধরনের চালের দাম কমবে। এবার তৃতীয় অজুহাত হচ্ছে করোনায় আতঙ্কিত হয়ে ক্রেতারা চাল বেশি কিনেছেন। যে কারণে মিলে চাল সংকট। তাই চাহিদার তুলনায় সরবরাহ দিতে পারছেন না। এসবই মনগড়া। কারণ, দেশে পর্যাপ্ত চাল আছে। অতি মুনাফা লুটতেই এ কৌশল।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বর্তমানে চালের দাম বাড়া অযৌক্তিক। দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। আমন মৌসুমে ধানেরও বাম্পার ফলন হয়েছে। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এর কারণ অনুসন্ধান করে দাম বাড়ানোর পেছনে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া দাম যেন আর না বাড়ে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাজারে কারসাজি বন্ধে সরকার ইতিমধ্যে নজরদারি বাড়ানোর কথা বলেছে। গঠন করা হয়েছে বিশেষ টিম। খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে কেউ যদি কারসাজির চেষ্টা করে, তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সদস্য আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, আমরা প্রতিদিন বাজার তদারকি করছি। এ সময় চালের দাম বাড়িয়ে বিক্রির দায়ে অনেক প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনছি। কোনো অনিয়ম পেলে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। দাম সহনীয় রাখতে অভিযান চলমান আছে। আশা করি, কয়েকদিনের মধ্যে দাম কমে আসবে।
এদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার রাজধানীসহ সারা দেশে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ওএমএসের মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি শুরু করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ১৫ই মার্চ পর্যন্ত সরকারি গুদামে খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ ১৭ লাখ ৫১ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ২৯ হাজার টন এবং গম ৩ লাখ ২২ হাজার টন। এই মজুদ সন্তোষজনক। এ মুহূর্তে খাদ্যশস্যের কোনো ঘাটতি নেই বা আশঙ্কাও নেই।