ঢাকা :সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথের ‘নিখোঁজ’ ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীর বিষয়ে তথ্য চেয়েছে । এরা সবাই জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত কি না-তা নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কেবল এই তালিকা নয়, আর্টিজানে হামলার পর থেকে প্রায় প্রতিদিন কোনও না কোনও শিক্ষার্থীর বিষয়ে জানতে নর্থ সাউথের সঙ্গে যোগাযোগ করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য বেনজীর আহমেদও। তিনি বলেন, ‘যাদের বিষয়ে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে, সেগুলো সরকারকে সরবরাহ করতে প্রস্তুতি চলছে। আমরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তারা কেবল আমাদের ছাত্র নয়, গোটা দেশের সম্পদ। এই তরুণরা যেন ভুল পথে পা না বাড়ায়, সে জন্যও এখন থেকে নজরদারি থাকবে আমাদের। কেউ যেন তাদের মগজ ধোলাই করতে না পারে সে জন্য প্রচারণামূলক বা তাদের সঙ্গে আলোচনার পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে’।
তবে কাদের বিষয়ে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে তা এখনই প্রকাশ করতে চাইছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল মুত্তাকিনও এ বিষয়ে কোনও তথ্য দিতে পারেননি। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে। তবে আমাদের মাধ্যমে কিছু করা হয়নি’।
সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ঘুরে ফিরে আসছে দেশের নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আর ইংরেজি মাধ্যমের বেশ কিছু স্কুলের নাম। বিশেষ করে গুলশানের হলি আর্টিজান আর শোলাকিয়া ময়দানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির দুই শিক্ষার্থীর নাম আসার পর চাপে পড়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। কেবল দুই শিক্ষার্থী নয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক এক শিক্ষকও আর্টিজান হামলায় সন্দেহভাজন। দেশের প্রথম ‘গুপ্তহত্যা’ রাজীব হায়দার হত্যায়ও এসেছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক সাত শিক্ষার্থীর বিচার হয়েছে নিম্ন আদালতে।
বলতে গেলে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া উচ্চবিত্ত শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রথম পছন্দ থাকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বলতে গেলে নির্বিঘ্নেই কার্যক্রম চালিয়েছে উগ্রবাদী ধর্মভিত্তিক সংগঠন হিযবুত তাহরীর। এই সংগঠনের হাত ধরেই শিক্ষার্থীদের একাংশ জঙ্গি তৎপরতায় জড়িয়েছে বলে অভিযোগ আছে। হিযবুত নিষিদ্ধ হলেও ভিন্ন নামে বা গোপনে তৎপরতা চালিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে, পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে একাংশকে উগ্রবাদে জড়িয়েছে আরেক নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলাটিম।
তবে আর্টিজান হামলার আগে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একাংশের জঙ্গি তৎপরতায় জড়ানোর বিষয়টি উদ্বেগ তৈরি করে গোটা দেশে। কারণ এই ঘটনার আগ পর্যন্ত জঙ্গি তৎপরতায় মূলত নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান বা কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ছাত্র-শিক্ষকদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে উচ্চবিত্তের সন্তানরা এই ধরনের উগ্রবাদে জড়ানো এবং ইরাক-আফগানিস্তান ধাঁচে জঙ্গি হামলার পর তোলপাড় তৈরি হয়েছে গোটা দেশে। আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তানরাও কেন এই তৎপরতায় জড়াচ্ছে সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করছে সরকার।
বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারের কয়েকশ তরুণ ‘নিখোঁজ’ হওয়ার তথ্য পেয়েছে সরকার। এদের একটি বড় অংশ নামিদামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে তথ্য দিতে আহ্বান জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আর এখন পর্যন্ত সত্তর জনেরও বেশি তরুণের নাম পেয়েছে সরকার।
এই অবস্থায় নর্থ সাউথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনও শিক্ষার্থী এক সেমিস্টারের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তার ছাত্রত্ব বাতিল হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ট্রাস্টির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, পুরো বিষয়টি তাদের ভাবমুর্তির জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য বেনজীর আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জঙ্গি ইস্যুতে আমরা সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবো। পাশাপাশি অভিভাবকদেরও তাদের সন্তানদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, আমাদের কাছে ছাত্ররা থাকে ছয় ঘণ্টা। বাকি সময় তারা কোথায় কী করছে সে বিষয়ে আমাদের পক্ষে নজরদারি করা সম্ভব নয়, এই কাজটি করতে হবে অভিভাবকেদেরই’।
‘হলি আর্টিজান’ রেস্টুরেন্টে কমান্ডো অভিযানে নিহত পাঁচ ‘জঙ্গির’ মধ্যে একজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষার্থী নিবরাস ইসলাম। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে ঈদের জামাতে হামলা চেষ্টার সময় গুলিতে নিহত আবীর রহমানও ছিলেন নর্থসাউথের বি্বিএর ছাত্র।
এরও আগে ২০১৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার হওয়া আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের ৯ সদস্যের মধ্যে জুন্নুন সিকদার ও রেজওয়ান শরীফ ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সম্প্রতি যে ১০ তরুণকে ফিরে আসার আকুতি জানিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে টেলিভিশনে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের একজন জুন্নুন সিকদার।
ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যায় যাদের বিচার হয়েছে তাদের মধ্যে রেদোয়ানুল আজাদ ওরফে রানা, ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ, মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক, এহসান রেজা ওরফে রুম্মন, নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ, নাফিস ইমতিয়াজ এবং সাদমান ইয়াছির মাহমুদও ছিলেন নর্থ সাউথের ছাত্র। এদের মধ্যে রানা ও দীপের ফাঁসির আদেশ হয়েছে এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে আটক বাংলাদেশি তরুণ কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসও ছিলেন নর্থসাউথের ছাত্র।
কেবল ছাত্র নয়, নর্থ সাউথের শিক্ষকদের একাংশও নানা সময় জড়িয়েছেন উগ্রবাদী তৎপরতায়। আর্টিজান হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমকে ঘিরেও সন্দেহের বলয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। শিক্ষার্থীদেরকে এই সংগঠনে জড়ানোর বিষয়ে তার একটি ভূমিকা ছিল শুরু থেকেই। এ বিষয়ে তদন্তে প্রমাণ পাওয়ার পর হাসনাত করিমসহ চার শিক্ষককে নর্থ সাউথ থেকে বহিষ্কার করা হয় ২০১২ সালেই। তবে তারা কতজন শিক্ষার্থীকে এই উগ্রবাদী সংগঠনে জড়াতে পেরেছিলেন, সেই তথ্য অজানাই রয়ে গেছে।
হলি আর্টিজানে হামলাকারীরা জিম্মিদেরকে হত্যা করলেও হাসনাত করিম বা তার পরিবারের সদস্যদেরকে কিছুই করেনি তারা। আর রেস্টুরেন্টের ভেতরের ঘটনায় পাওয়া ভিডিও ফুটেজে জঙ্গিদেরকে সহায়তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জিম্মিদের উদ্ধারে সেনা অভিযানের পর হাসনাত করিমকে গোয়েন্দারা নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা রেজাউল করিম। তবে পুলিশ জানিয়েছে, হাসনাত করিম এখন তাদের হেফাজতে নেই।
নর্থ সাউথের ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য বেনজীর আহমেদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘হাসনাত করিমকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার পাশাপাশি লাইব্রেরিতে পাওয়া হিযবুত তাহরীরের বিভিন্ন বই পুড়িয়ে দেয়া হয়। কেবল এটুকুই নয়, বর্তমানে কর্মরত সব শিক্ষকদের বিষয়ে খোঁজ নেয়া হচ্ছে। তারা অন্য কোনও সংগঠনে জড়িত কি না, তা যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রেও কেউ কোনও উগ্র সংগঠনে জড়িত কি না, তা যাচাই করা হবে’।