ঢাকা : দুই তরুণের অতর্কিত আক্রমণ। ঘটনাস্থল কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া। তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের সংখ্যা আক্রমণকারীদের অন্তত চার গুণ। কিন্তু হতচকিত হয়ে বলতে গেলে কিছুই করতে পারেনি পুলিশ। আর বোমা ও চাপাতির আঘাতে প্রাণ হারায় পুলিশেরই দুই সদস্য।
ঘটনাস্থল ঢাকার আশুলিয়া। এবারও তল্লাশি চৌকিতে অতর্কিত হামলা। সেখানেও হামলাকারী তিন থেকে চারজন। আর পুলিশের সংখ্যা ছিল আট থেকে দশজন। এক পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করলেও তার সহকর্মীরা প্রতিরোধের চেষ্টাও করেনি। পালিয়ে যায় তারা সবাই। কেউ কেউ আবার অস্ত্র ফেলে।
ঘটনাস্থল গাবতলী। সেই একই কায়দায় তল্লাশি চৌকিতে হামলা। ধারালো অস্ত্র দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে খুন করে নির্বিঘেœ পালিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা। আর নিরাপত্তা বাহিনীর অন্য সদস্যরা বলতে গেলে হাত গুটিয়ে বসে।
এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে তিনটি ভিন্ন সময়ে, তিনটি আলাদা এলাকায়। তিনটি ঘটনার সময়ই নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশের বিশেষ নজরদারি চলছিল, সতর্কতার জন্য তল্লাশি চৌকি বসানো হয় তিনটি এলাকাতেই। কিন্তু কোথাও জঙ্গি আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো মার খেয়ে নিজেরাই পালিয়েছে।
প্রতিটি আক্রমণের সময় ঘটনাস্থলে পুলিশের সংখ্যা হামলাকারীদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ কোথাও জঙ্গিদের মোকাবেলা বা প্রতিরোধ করতে পারেনি। দুটো ঘটনাতে আক্রান্ত সহকর্মীদেরকে ফেলে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আর একটি ক্ষেত্রে খবর পেয়ে অন্য পুলিশ সদস্যরা এসে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি।
তল্লাশি চৌকিতে একাধিক হামলার পর দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা, রাইফেল লোড অবস্থায় রাখাসহ নানা নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জারি করা এসব নির্দেশনাও পালনে শৈথিল্যের অভিযোগ উঠেছে। শোলাকিয়ায় এই সুযোগেই দুই ‘জঙ্গি’ ধারালো অস্ত্র দিয়ে নয়জনকে কোপায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
এসব ঘটনায় জঙ্গি মোকাবেলায় পুলিশের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন যে, বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেই গলদ আছে। নইলে গোপনে স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নেয়া গুটি কয়েকজ জঙ্গি প্রতিবার কেন এবং কীভাবে তাদের চেয়ে বেশিসংখক পুলিশকে নাজেহাল করতে পারার কথা না।
পুলিশের এএসপি পর্যায়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এটা স্বীকার না করার কোনো কারণ নেই যে, আমাদের সাধারণ সদস্যরা সাম্প্রতিক জঙ্গি আক্রমণ মোকাবেলার করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষ নয়।’ উদাহরণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘ধরুন নিবরাস আহমেদের মতো (গুলশানের আর্টিজানে সন্দেহভাজন হামলাকারীদের একজন) একজনের গাড়ি আটকালে তিনি যদি ইংরেজিতে বক্তব্য দেয়, তাহলে পুলিশ সদস্যরা নিশ্চিত ভড়কে যাবে। ভাববে, কোনো ভিআইপির সন্তানকে ধরে ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে কি না’।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, চাকরিতে নিয়োগের পর ছয় মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষে পুলিশ সদস্যদেরকে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে পাঠানো হয়। এরপর বছরে একবার গুলির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এই দক্ষতা নিয়ে পুলিশ জঙ্গিদের সঙ্গে পেরে উঠে না কেন? জবাবে ওই এএসপি বলেন, বেশিরভাগ সময় কিছু বুঝে উঠার আগেই হামলা হয় আর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবেই তাৎক্ষণিকভাবে অন্যরা হতচকিত হয়ে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার ইউসুফ আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলা হলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া জন্য সেখানে দায়িত্বরত জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার। জানমাল রক্ষায় পুলিশকে গুলি করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই দায়িত্ব পালনে শৈথিলতার অভিযোগ আছে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া অবশ্য স্বীকার করেছেন জঙ্গি মোকাবেলায় তার বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণে ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে জঙ্গি হামলা মোকাবেলায় পুলিশ ব্যর্থ বলে অনেকে সমালোচনা করেছেন। পুলিশকে উন্নত প্রশিক্ষণ না দেয়াকে এ জন্য অনেকে দায়ী করেন। জঙ্গিদের নতুন কৌশল মোকাবেলায় পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণে পরিবর্তন আসছে।’
তিনটি ঘটনা
গাবতলীতে হামলা: ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর রাত সাড়ে নয়টার দিকে গাবতলীতে বিশেষ তল্লাশি চৌকিতে হামলা করে সন্ত্রাসীরা। সেখানে দায়িত্ব পালন করা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ইব্রাহিম মোল্লাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনার সময় সেখানে দায়িত্বে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যরা গুলি করেনি বা কাউকে ধরতে পারেনি।
আশুলিয়ায় হামলা: ২০১৫ সালের ৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে আশুলিয়ার বারইপাড়ায় দুই শিল্প পুলিশকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। পরে শিল্প পুলিশ সদস্য মুকুল হোসেন মারা যান ঘটনাস্থলেই। আর হাসপাতালে ভর্তি করা হয় নুর আলমকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশ সদস্যরা একটি মোটরসাইকেলের গতিরোধ করলে তিন আরোহী রাম দা দিয়ে পুলিশ সদস্যদেরকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। পরে ফাঁকা গুরি ছুড়ে দুর্বৃত্তরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
তখন ওই তল্লাশি চৌকিতে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যরা দুর্বৃত্তদেরকে প্রতিহত করার চেষ্টা না করে পালিয়ে যায়।
শোলাকিয়ায় হামলা: গত ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ময়দানে ঈদুল ফিতরে দেশের বৃহত্তম জামাতের প্রস্তুতি চলাকালে ময়দানের বাইরে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলা হয়। পুলিশ এক ব্যক্তির ব্যাগ তল্লাশি করতে গেলে এক জঙ্গি এক পুলিশ কনস্টেবলের ঘাড়ে কোপ দেয়। এরপর ছোড়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করার চেষ্টা করে তারা।
হামলাকারীদের গুলি ও দায়ের কোপে অন্তত নয়জন কনস্টেবল আহত হয়। পরে আরেক পুলিশ সদস্য স্থানীয় মসজিদের বাথরুমে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলে সেখানে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরে পুলিশের অতিরিক্ত সদস্য এসে গুলি করে একজনকে হত্যা করে, আহত অবস্থায় আটক হয় আরও একজন।