ঊষর মরুভূমিময় জর্ডানকে বলা হয় এক্ট্রিম প্রি-কশন বা অতিমাত্রায় সতর্কতার কারণে প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস এখনও কাবু করতে পারেনি । কিন্তু করোনা বা কোভিড-১৯ ঠেকাতে দেশটিতে ১৭ই মার্চ থেকে জারি করা জরুরি অবস্থা এবং পরবর্তী সময় থেকে এখনও বহাল কারফিউ বহু মানুষকে অর্থকষ্টে, বিশেষ করে চরম খাদ্য সংকটে ফেলে দিয়েছে। এরমধ্যে অনাহারী-অর্ধাহারী অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন অবৈধ-কর্মহীন বিদেশি শ্রমিকরা। সেখানে কয়েক হাজার বাংলাদেশির অবস্থা বেশ নাজুক। দেশটিতে বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশির বাস। এর মধ্যে অবৈধ কমবেশি ১৫ হাজারের মত। সবাই অর্থকষ্টে বা অভুক্ত নয়। কমিউনিটি এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সূত্রে যে খবরা-খবর বেরিয়েছে তাতে খাদ্য সংকটে থাকা বাংলাদেশির সংখ্যা ১০-১৫ হাজার বলে প্রচার আছে।
কিন্তু দূতাবাসের হিসাবে সেই সংখ্যা ৫ হাজারের কম হবে। কারণ
দূতাবাস কমিউনিটির সঙ্গে মিলে জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রদানে যে তালিকা তৈরি
করেছে এবং সেটি ধরে এরই মধ্যে ত্রাণকার্য্য শুরু হয়েছে, সেখানে
যাচাই-বাছাইয়ে আড়াই হাজারের নাম টিকেছে। পরিসংখ্যান বলছে, জর্ডানে বর্তমান
সংকটে বড় বিপাকে পড়েছেন প্রায় ১০-১৫ হাজার বাংলাদেশী আছেন যারা ফ্রি ভিসায়
নিজস্ব ব্যবসা পরিচালনা করেন অথবা দৈনিক ভিত্তিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
তাদের মধ্যে বৈধ কাগজপত্রবিহীন প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার। করোনার কারণে
তারা বেশ দিন ধরে কর্মহীন। তবে তাদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থা সমান নয়।
আম্মানে
নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের মতে, সংখ্যা মূখ্য নয়, তারা বৈধ কি অবৈধ- সেটাও
বৈশ্বিক সংকটে বিবেচ্য নয়। তারা বাংলাদেশি, তাদের বাঁচাতে হবে- এই বিবেচনায়
দূতাবাস এবং কমিউনিটি জরুরি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে বলে জানান নব নিযুক্ত
রাষ্ট্রদূত নাহিদা সোবহান।
জর্ডানে থাকা বাংলাদেশির ৯০ভাগই নারী শ্রমিক:
কমিউনিটি
এবং দূতাবাস জানিয়েছে, জর্দান নদীর পূর্বতীরের ট্রান্সজর্ডান আজকের
স্বাধীন জর্ডান রাষ্ট্রে বাংলাদেশিরা কাজ করছেন বছরের পর বছর ধরে। দেশটির
অন্তত ৩০টা শিল্প-কারখানা এলাকায় বাংলাদেশিরা রাজত্ব করছেন তাদের কাজ দিয়ে।
তারা এক্সপার্ট। যাদের ৯০ ভাগই নারী শ্রমিক। মূলত তাদের কাজ গার্মেন্টসে।
কারফিউ শুরুর পর জর্ডানের শিল্পাঞ্চল আল তাজুমাসহ বিভিন্ন এলাকায় থাকা
বাংলাদেশিরা কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন জানিয়ে আবু সুলাইমান নামের বাংলাদেশি এক
শ্রমিক (যার বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবলে) গতকাল মানবজমিনকে বলেন, শুরুতে
কারখানা এলাকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মার্চে জরুরি অবস্থা জারি পর
থেকে তারা বেকার-বদ্ধ ঘরে ছিলেন। পুরো এলাকা লকডাউন ছিলো। তখন তাদের বেশ
কষ্টের সময় গেছে। কিছু কিছু বাড়িতে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেছে। তবে বেশিরভাগই
কোনো ত্রান পায়নি। রুমানা নামে নেত্রকোনার এক নারী শ্রমিক যিনি আকাবায়
থাকেন তার মতে, অনেকে এখনও কষ্টে আছে। তবে দূতাবাস তাদের নাম লিস্টে তুলেছে
বলে জানান তিনি। মুরাদ শাহী নামের আম্মানে থাকা এক শ্রমিক তিনি নিজেকে
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দাবি করে বলেন, আমি ঢাকায় বিভিন্ন অনলাইনে খবর পাঠাই।
নোয়াখালির চৌমুহনী এলাকায় থাকাকালে সাংবাদিকতা করতেন জানিয়ে মুরাদ বলেন,
অনেকে অবৈধ। কাজ কর্ম না থাকায় তারা কষ্টে আছেন। তিনি নিজেও অবৈধ, বৈধতার
জন্য দূতাবাসের সহায়তা নিয়েছেন জানিয়ে বলেন, এই মুহুর্তে খাদ্যের সংকটটাই
বেশি। কারফিউ যতদিন জারি থাকবে ততদিন কেউ দৈনিক ভিত্তিতে কাজে যেতে পারবে
না বলে জানান তিনি।
দূতাবাস কি করছে?
বিদেশে
যে কোনো ক্রাইসিসে দূতাবাসকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। অতীতের অনেক ঘটনায় তা-ই
দেখা গেছে। জর্ডান তথা মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম দায়িত্ব পাওয়া নারী রাষ্ট্রদূত
নাহিদা সোবহান কী করছেন। জর্ডানে তো বেশিরভাগই নারী শ্রমিক তাদের এই কষ্টের
সময়ে রাষ্ট্রদূত কতটা সক্রিয়? জানতে চাইলে দূতাবাসের এক কর্মকর্তা
মানবজমিনকে বলেন, শুরুতে সংকটটি বুঝা যায়নি, তাই কিছুটা সমস্যা হয়েছে। এখন
তালিকা ধরে কারফিউ পাস নিয়ে এলাকায় এলাকায় খাদ্য পৌঁছানো হচ্ছে। অভাব
অভিযোগও কমে আসছে।
রাষ্ট্রদূত মিজ সোবহান মানবজমিনকে বলেন, খাদ্য
সঙ্কটে থাকা ব্যক্তিদের একটি তালিকা ইতোমধ্যে দূতাবাস প্রস্তুত করেছে।
এছাড়া দূতাবাসের ফেইসবুক ও হট-লাইনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যারা যোগাযোগ করছেন
তাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এটি চলমান থাকবে জানিয়ে তিনি
বলেন, প্রকৃত খাদ্য সঙ্কটে থাকা ব্যক্তি যে কোনো সময় দূতাবাসকে অবহিত করতে
পারবেন, দূতাবাস প্রত্যেককেই এই সহযোগিতা প্রদান করবে।
কারখানা বা
শিল্প এলাকায় আবাসিক সুবিধা সম্বলিত বিদেশি শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন জানিয়ে
রাষ্ট্রদূত বলেন, জর্ডান সরকারে করোনা যুদ্ধে সফল হতে চলেছে। আক্রান্তে
সংখ্যা এ পর্যন্ত ৩৭২, মারা গেছেন ৭জন। কিছু দিনের মধ্যে কারফিউ শিথিল
হওয়ার আভাস মিলেছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, জর্ডান সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত
হচ্ছে কারাখানা কম্পাউন্ডের বাইরে থেকে কোনো শ্রমিক ভেতরে ঢুকবে না, আর
ভেতরের (আবাসিক) কেউ বাইরে আসবে না। ফলে করোনা ট্রান্সমিশনের ঝুঁকি থাকবে
না। আর এটি হলে কারফিউর মধ্যেও বিদেশি শ্রমিকদের কাজ করতে কোনো অসুবিধা
নেই। বিদেশি শ্রমিকদের মার্চের বেতন হয়েছে। বাংলাদেশিরাও সেটি পেয়েছেন
জানিয়ে তিনি বলেন, ফলে এখন কারখানা এলাকায় অন্তত খাদ্য সংকট কমে আসবে।