২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার পর সারা দেশের মানুষের মতো আমরাও উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার মধ্যে প্রতিটি দিন কাটাতে লাগলাম । ঠিক এখন যেমন করোনা আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে । তখনও সামনে ছিল অনিশ্চিৎ এক ভবিষ্যৎ । পাকহানাদারদের ভয়ে তটস্থ ছিলাম ।
আমরা তখন আব্বার চাকরির সুবাদে নাটোর উত্তর বড়গাছার ওয়াপদার এসডিও বাংলোটিতে থাকতাম । (এটি প্রায় দু’দশক যাবৎ পরিত্যাক্ত।) একমাত্র রেডিও এবং পত্রিকা ছাড়া খবর সংগ্রহের আর কোনো মাধ্যম ছিল না।
আমরা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় বাসার সামনে কাঁঠাল গাছের (গোলাকার চিহ্নিত স্থানে) নিচে অফিসের কর্মকর্তাবৃন্দ ও মহল্লার কয়েকজন উৎসুখ ব্যক্তি আকাশবাণী, বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনার জন্য একত্রিত হতাম । খবর শেষে নিজেদের মধ্যে পর্যালোচনা হতো । নাটোরসহ পুরো উত্তরবঙ্গ তখন বাঙালি পুলিশ, আনসার, সেনাসদস্যদের প্রবল প্রতিরোধে কারণে মুক্ত ছিল । আমরা বিকেলে শহরের কেন্দ্রে নতুন কোনো খবরের আশায় জড়ো হতাম ।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের এক সকালে শহরময় মাইকে প্রচার করা হলো, বিহারী পাড়া লেঙ্গুরিয়া ও জংলীতে পাকসেনারা ছদ্মবেশে অস্ত্রশস্ত্রসহ আশ্রয় নিয়েছে । যাঁদের কাছে বন্দুক বা অন্য কোনো অস্ত্র আছে, তাঁদেরকে শীঘ্র রেলগেটের কাছে চলে আসার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে । আব্বার একটি একনলা বন্দুক ছিল । তিনিসহ অন্যান্যরা বন্দুক নিয়ে এবং সাঁওতাল ও আদিবাসীরা তীর-ধনুক নিয়ে সেখানে ছুটলেন । পুলিশ সদস্যরাও রাইফেল নিয়ে ছুটলেন ।
কিছুক্ষণ উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির পর বিহারীরা সাদা পতাকা উত্তোলন করে আত্মসমর্পনের ইঙ্গিত দিলো । একদল পুলিশ এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সেখানে গিয়ে জানতে পেলেন, সেখানে কোনো পাকসেনা নেই । তবুও বিহারীদের বিশ্বাস করা ঠিক হবে না ভেবে, দুটি গ্রামের সকলকে লাইন ধরে হাঁটিয়ে নাটোর জেলখানায় ভরা হলো ।
লেখকঃ মুক্তিযোদ্ধা, আমেরিকা প্রবাসী। প্রকাশক, বিদ্যা প্রকাশ